এমটিএফই প্রতারণা: টাকা খুইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে দুষছেন সহকর্মী–শিক্ষার্থীরা
মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড প্রতারণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নাম জড়িয়েছে। তাঁর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তাঁরই বিভাগের কয়েক শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা মুনাফার আশায় এমটিএফই ট্রেড নামের একটি মুঠোফোন অ্যাপে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রতারণার শিকার হয়ে তাঁরা প্রায় ২০ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে, তিনি স্বরূপ হোসেন। সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তিনি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এমটিএফই অ্যাপের মাধ্যমে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যেমন বিটকয়েন) লেনদেনের সঙ্গে স্বরূপ হোসেনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এই শিক্ষক দাবি করেছেন, এমটিএফই সম্পর্কে তাঁর ‘কোনো জ্ঞানই নেই’।
এমটিএফই অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। ভার্চ্যুয়াল পঞ্জি স্কিম ও বহুস্তর বিপণন (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম) মডেলেও কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। ‘এমটিএফই ট্রেড’ নামের একটি অ্যাপে শুধু মুঠোফোন নম্বর দিয়েই হিসাব খোলা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিরাট অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই।
বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, এমএলএম ব্যবসা ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন নিষিদ্ধ। গত ২৫ আগস্ট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বরূপ হোসেনের মাধ্যমে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করে অর্থ খুইয়েছেন, এমন অন্তত তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের একজন বলেন, ‘স্বরূপ হোসেন এমটিএফই অ্যাপে নিজে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। তিনি আমাদের প্রতিদিন দেখাচ্ছিলেন যে ডলারে মুনাফা আসছে। পরে আড়াই মাস আগে আমরা তাঁর মাধ্যমে এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা বিনিয়োগ করি।’
ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘অন্যদের সঙ্গে সংগীত বিভাগের তিন শিক্ষার্থীও ২৬ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করেন। অ্যাকাউন্ট খোলার প্রায় ১৫ দিন পর এমটিএফই অ্যাপে আমাদের ডলারের ব্যালেন্স মাইনাস (ঋণাত্মক) দেখায়। তখন স্বরূপ হোসেনের মাধ্যমে জানতে পারি যে আমরা অর্থ খুইয়েছি।
এমটিএফই অ্যাপে দেখানো মাইনাস ডলার পরিশোধ না করলে উকিল নোটিশসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা জানানো হয়। পরে আমরা অ্যাপটি মুঠোফোন থেকে ডিলিট করে (মুছে) দিই। ফলে কোনো মুনাফা তো হয়ইনি, বরং আমাদের বিনিয়োগ করা ২৫-৩০ জনের ১৮-২০ লাখ টাকা গচ্চা গেছে।’
অর্থ খোয়ানো আরেক ব্যক্তি দাবি করেন, স্বরূপ হোসেন তাঁদের বারবার বলতে চেয়েছেন, এমটিএফই বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রতি আস্থার জায়গা থেকেই তাঁরা সেখানে বিনিয়োগ করেছিলেন। স্বরূপ হোসেন তাঁদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণাই করেছেন। তাঁদের অর্থ ফেরত দেবেন কি না, সে বিষয়ে স্বরূপ এখনো কিছু বলছেন না।
আরেক ভুক্তভোগী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বরূপ হোসেন সংগীত বিভাগের সদ্য সাবেক এক ছাত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে বিনিয়োগের টাকা নিতেন। পরে সেই টাকা তাঁর পরিচিত এক ব্যাংক কর্মকর্তার মাধ্যমে ডলারে রূপান্তর করে আমাদের এমটিএফই অ্যাকাউন্টে জমা করে দিতেন। তাঁর হয়ে দুজন মাঝেমধ্যে আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিতেন।’
যদিও স্বরূপ হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এমটিএফই অ্যাপে অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এই শিক্ষকের বক্তব্য, ‘এ ধরনের কোনো কিছু সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই। এ ধরনের কোনো কিছুর সঙ্গে আমি জড়িত নই।’
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বরূপ হোসেনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে যাঁরা এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেছেন, ‘এমটিএফই টাল গ্রুপ’ নামের হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের একটি গ্রুপ ছিল। সেই গ্রুপের অ্যাডমিন ছিলেন স্বরূপ। যদিও গত আগস্টের মাঝামাঝি অর্থ খোয়া গেলে একপর্যায়ে গ্রুপ থেকে বের হয়ে যান তিনি। ওই গ্রুপের সদস্যদের কথোপকথন ও বার্তা চালাচালির স্ক্রিনশট এবং স্বরূপ হোসেনের মাধ্যমে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর এ-বিষয়ক কথোপকথনের স্ক্রিনশট প্রথম আলোর কাছে রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিনিয়োগকারী শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এমটিএফই প্রতারণার বিষয়টি জানাজানির পর আজই (শনিবার) বিনিয়োগকারী শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন স্বরূপ হোসেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একধরনের সমঝোতার চেষ্টা করছেন।