সারা দেশে চোরাই বাইকের বড় নেটওয়ার্ক
ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে চুরি করে বিক্রি করা হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মোটরসাইকেল চুরিতে সিদ্ধহস্ত ২০টি চক্রের সন্ধান।
আবুল কালাম আজাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে। অল্প বয়সেই চুরিতে হাত পাকান। প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকায় এসে শুরু করেন রিকশা চুরি। আট বছর আগে জড়ান মোটরসাইকেল (বাইক) চোর চক্রে। এখন তিনি বড় একটি মোটরসাইকেল চোর চক্রের দলনেতা। দলে সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫। সারা দেশেই রয়েছে তাঁর চোরাই মোটরসাইকেলের বড় নেটওয়ার্ক।
চলতি বছরের জুলাই মাসে আবুল কালাম আজাদকে তাঁর সাত সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। উদ্ধার করা হয় ১৭টি চোরাই মোটরসাইকেল। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এর আগে অন্তত ১০ বার গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও শুরু করেন মোটরসাইকেল চুরি। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে চুরির পর মোটরসাইকেল পাঠিয়ে দেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
ডিবির সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস প্রথম আলোকে বলেন, আবুল কালাম আজাদের কৌশল হচ্ছে, চুরির জন্য একটি এলাকাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেছে নেওয়া। এরপর সেখানে বিয়ে করে একের পর এক মোটরসাইকেল চুরি করে কেটে পড়া। এভাবে তিনি বিভিন্ন এলাকায় ৩৩টি বিয়ে করেছেন। স্ত্রীরা সবাই ভাসমান নারী।
মোটরসাইকেল চুরিতে সিদ্ধহস্ত এমন অন্তত ২০টি চক্রের তথ্য রয়েছে ডিবির কাছে। তাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেও কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে আবারও চুরি শুরু করেন। এমনকি জেলে গিয়ে তাঁরা অন্য অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদেরও দলে ভেড়ান।
ডিএমপির চোরাই গাড়ি উদ্ধারসংক্রান্ত ৩১ মাসের (জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুলাই ২০২১ পর্যন্ত) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চোর চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া গাড়ির অর্ধেকই মোটরসাইকেল। এই সময়ে ১ হাজার ১২৩টি চোরাই গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল উদ্ধার হয়েছে ৫৪৫টি। উদ্ধার হওয়া অন্যান্য গাড়ির মধ্যে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, লেগুনা এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশাও রয়েছে।
গাড়ি চুরি প্রতিরোধ ও উদ্ধারে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের অধীনে আটটি বিশেষায়িত টিম কাজ করে। অধিকাংশ গাড়ি তারাই উদ্ধার করেছে।
৩১ মাসে ডিএমপি গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলা হয়েছে ৯২৯টি। এসব আসামির অধিকাংশই মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে জড়িত। গাড়ি চুরিসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রেও মোটরসাইকেল চুরির মামলাই বেশি। অনেক ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চুরিসংক্রান্ত মামলা পুলিশ নিতে চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘ইঁদুর–বিড়াল খেলা’ চলছেই
গত জুলাইয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) কুমিল্লা থেকে ফারুক নামের এক মোটরসাইকেল চোরকে গ্রেপ্তার করে। এর আগেও তিনি দুবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। জামিনে বেরিয়ে তিনি আবারও চুরি শুরু করেন।
ডিবি কর্মকর্তারা জানান, ফারুক লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে মুহুরি ছিলেন। ২০১২ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর কুমিল্লা সীমান্ত থেকে চোরাই মোটরসাইকেল এনে লক্ষ্মীপুরে বিক্রি করতেন। তখন একবার গ্রেপ্তার হন। কারাগারে গিয়ে তাঁর নেটওয়ার্ক আরও বড় হয়।
ডিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল চোরদের নিয়ে যেন ইঁদুর–বিড়াল খেলা চলে। গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় এবং আবারও চুরি শুরু করে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুরির মামলার আসামিদের বেশি দিন জেলে রাখা যায় না। আমাদের কাজ আইনের আওতায় আনা। সেটা করছি।’
‘বর্ডার ক্রস’ মোটরসাইকেল বলে বিক্রি
ডিএমপি সূত্র জানায়, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চুরি হওয়া মোটরসাইকেলগুলোতে নতুন পলি স্টিকার লাগানো হয়। বলা হয় কাস্টমসের নিলাম থেকে কেনা হয়েছে। এরপর ভুয়া কাগজ বানিয়ে, ভুয়া কাস্টমস নম্বর ও জিআর নম্বর দিয়ে প্রতারণা করে বিক্রি করা হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তেজগাঁও এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ৯টি চোরাই মোটরসাইকেলসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গ্রেপ্তার সোহাগ ও মো. সজল ডিবিকে জানান, তাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটরসাইকেল চুরি করেন। তারপর বৃহত্তর নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরে নকল কাগজপত্রসহ কম দামে বিক্রি করেন। তাঁরা বলতেন, এগুলো ‘বর্ডার ক্রস’ মোটরসাইকেল।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মোটরসাইকেল সীমান্তের ওপার থেকে আসে। আবার ঢাকায় চুরি হওয়া মোটরসাইকেল যেমন লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় আসে, তেমনি এখানে চুরি হওয়া মোটরসাইকেল আবার ঢাকায় বিক্রি হয়। গাড়ি চুরির ঘটনার মধ্যে ৮০ শতাংশই মোটরসাইকেল চুরিসংক্রান্ত ঘটনা বলেও জানান তিনি।
চোর চক্রের পেছনে প্রভাবশালীরা
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার ভাষ্য, মোটরসাইকেল চোর চক্রের পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাত রয়েছে। চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার হলে তাঁদের জামিনে বের করার জন্য আলাদা গ্রুপ কাজ করে।
একটি ঘটনার উল্লেখ করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের অক্টোবরে লক্ষ্মীপুর থেকে আন্তজেলা মোটরসাইকেল চোর চক্রের প্রধান ইয়াসির আরাফাত খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের খবর শুনে তাঁকে ছাড়াতে ছুটে আসেন লক্ষ্মীপুরে কর্মরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি সম্পর্কে ইয়াসিরের মামা। মামার প্রভাব খাটিয়ে ইয়াসির ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চুরি হওয়া মোটরসাইকেল বৃহত্তর নোয়াখালী এলাকায় বিক্রি করেন। এভাবে তিনি শতাধিক মোটরসাইকেল চুরি ও বিক্রি করেছেন। বিভিন্ন সময় তিনি ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়েও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন।
শুধু এ ঘটনাই নয়, চলতি বছরের মার্চে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হৃদয় পাঠানকে গাড়ি চোর চক্রের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। ঢাকায় চুরি হওয়া গাড়ি ও মোটরসাইকেল চোর চক্রের একটি চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
মোটরসাইকেল চুরি রোধে একটি সফটওয়্যার তৈরির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানালেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি বলেন, ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করা যাবে চুরি হওয়া মোটরসাইকেলটি কোন এলাকায় চলাচল করছে। চুরি প্রতিরোধে তাঁদের অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগ
অনেকেই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় পুলিশের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। মামলা করতে গেলেও পুলিশ এ নিয়ে গড়িমসি করে। ইকবাল হোসেন নামের পল্লবীর এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, আড়াই বছর আগে তাঁর বাসার দারোয়ানকে কুপিয়ে একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়। তিনি মামলা করতে গেলে পল্লবী থানা পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। পরে থানা থেকে বলা হয় কোপানোর কথা বাদ দিলে মামলা নেওয়া হবে। মামলার পর দুই চোরকে গ্রেপ্তার করলেও মোটরসাইকেল আর উদ্ধার হয়নি। পুলিশও আর তদন্ত করেনি।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল চোর চক্রের বিরুদ্ধে ডিএমপির অভিযান সব সময় চলমান থাকে। ঢাকার যেকোনো স্থানে চুরির ঘটনা ঘটলে ডিবির সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বে থাকা টিম চক্রকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করে।
পুলিশ মামলা নিতে চায় না, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে ঋণ নিয়ে বা কিস্তিতে মোটরসাইকেল কেনেন। কেউ কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মোটরসাইকেল চুরির নাটক সাজান। এ ধরনের সন্দেহ হলে থানা পুলিশ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বলে। তদন্ত করে চুরির সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই মামলা হয়।