সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল
যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার অনিয়ম
হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) উত্তম কুমার বড়ুয়াকে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় ৯ মাস পর গতকাল পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম অনুসরণ না করে ও বাজারদর যাচাই না করে বেশি দামে এসব মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে এসব তথ্য বের হয়ে এসেছে।
এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) উত্তম কুমার বড়ুয়াকে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
উত্তম কুমার বড়ুয়া আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের যুগ্ম মহাসচিব।
অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ঔষধ প্রশাসন অনুবিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্ব তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ বছরের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় ৯ মাস পর গতকাল পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
ওটি লাইট, কোবলেশন মেশিন ও অ্যানেসথেসিয়া মেশিন কেনাকাটায় ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকার আর্থিক অনিয়ম।
তদন্ত কমিটি জানায়, এর আগে উত্তম কুমারের বিরুদ্ধে এমআর মেশিন কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ২০১৬ সালে সাজা হিসেবে তাঁর বেতন এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল।
কমিটি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, আর্থিক অনিয়ম প্রকাশের পর সাজা পাওয়া একজন কর্মকর্তাকে দেশের স্বনামধন্য একটি হাসপাতালের পরিচালকের পদে বহাল রাখা ঠিক কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ ছাড়া তাঁকে এ ধরনের ক্রয়সংক্রান্ত কার্যক্রম করার সুযোগ দেওয়াও ঠিক হয়নি।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার হাতে এখনো এমন কোনো চিঠি আসেনি। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয়। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি যা করেছি, তা সরকারি ক্রয় বিধিমালা মেনে করেছি। এসব কেনাকাটার বিষয়েই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ও মৌখিক নির্দেশ ছিল।’
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মোট আটটি ওটি লাইট ৬ কেটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। প্রতিটি লাইটের দাম পড়েছে ৭৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে, যা বাজারমূল্যের চেয়ে ২৫৬ শতাংশ বেশি। এতে সরকারের ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
একই ওটি লাইট রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকায় এবং চট্টগ্রাম মেডিকেলে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায়, স্যার সলিমউল্লাহ মেডিকেল কলেজে ২৩ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ‘হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট’ কর্মসূচির আওতায় এসব লাইটের প্রতিটির মূল্য ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ওটি লাইটের চাহিদা ২০টি। ক্রয় পরিকল্পনায় এমনটাই বলা আছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশি দামে আটটি লাইট কেনে। এর মধ্যে দুটি লাইট কেনা হয় আরসিএস এন্টারপ্রাইজ থেকে।
এ ছাড়া দুটি ‘কোবলেশন মেশিন’ কেনা হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে মূল্যতালিকা অনুমোদন করা হয়েছে, সেখানে এর মূল্য ধরা হয়েছে প্রতিটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুটির দাম সর্বোচ্চ ৩২ লাখ টাকা। ফলে সরকারের ৭৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া মেশিনের চাহিদা রয়েছে ১৫টি। এএসএল নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ভেন্টিলেশনসহ দুটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ১ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকায় কেনা হয়। অর্থাৎ একটির দাম পড়েছে ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিয়াপসের কর্মসূচির সহায়তায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, সেখানে প্রতিটি মেশিনের মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬০০ টাকা। সে হিসেবে দুটির দাম সর্বোচ্চ ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ টাকা হওয়ার কথা। এ মেশিন কিনে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়ম করে সরকারি অর্থের অপব্যবহারের জন্য হাসপাতাল পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া, বাজারদর কমিটির সদস্য নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৌমিত্র সরকার, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রতন দাশ গুপ্ত, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এ এস এম কামরুজ্জামান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত করে যে যে বিষয়ে গুরুতর অনিয়ম পেয়েছি, সেসব বিষয় উল্লেখ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’ সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়া এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কমিটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে, রেকর্ডপত্র যাচাই করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।’
সরকারি হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একজন পরিচালক এভাবে নিয়ম লঙ্ঘন করে, বাজারে দাম যাচাই–বাছাই না করে কীভাবে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনেন, তা বোধগম্য নয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ছাড়া যাঁরা প্রশাসনিক অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরি করেছেন, তাঁদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা উচিত। প্রসঙ্গত, এই বিএমএরই কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য উত্তম কুমার বড়ুয়া।