বগুড়ায় প্রকাশ্যে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গলা কেটে হত্যা

শহরের জনাকীর্ণ বাজারে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে পিছনে ধাওয়া করছে দুর্বৃত্তরা। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছেন ভীতসন্ত্রস্ত এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। কিছু দূর দৌড়ানোর পর একটি দোকানের সামনে পড়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকা দুর্বৃত্তরা হামলে পড়ল ব্যবসায়ীর ওপর। এরপর সবার সামনেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মুহূর্তেই গলা কেটে হত্যা করা হলো তাঁকে। শ খানেক মানুষের সামনে জলজ্যান্ত একজনকে এভাবে হত্যা করা হলেও প্রতিবাদ করেনি কেউ। খুনের পর ‘বীরদর্পে’ অস্ত্র উঁচিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। লোমহর্ষক এ ঘটনা আজ বৃহস্পতিবার বগুড়া শহরের।

বগুড়া শহরে দিনেদুপুরে রাস্তায় ফেলে জিয়াউদ্দিন জিয়া (৪২) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আজ বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে শহরের ব্যস্ততম রাজাবাজার এলাকার পদ্মা ম্যানশনের (দত্ত স্টোর) সামনে এ ঘটনা ঘটে।
শহরের বড়গোলা মোড়ে দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পুলিশের সামনে থেকে ধাওয়া দিয়ে রাজাবাজার এলাকায় নিয়ে ওই ব্যবসায়ীকে গলা কেটে হত্যা করা হলেও কোনো পুলিশ তাঁকে বাঁচাকে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জিয়াউদ্দিন শহরের ধরমপুর বাজারের ‘মা জুয়েলার্স ও ইমিটেশন’ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার।

পুলিশ ও স্বজনদের দাবি, বসতবাড়ির পাঁচ শতক জায়গা নিয়ে চাচাত ভাইদের সঙ্গে বিরোধ চলছিল জিয়াউদ্দিনের। কয়েক দিন আগে এ নিয়ে মারামারির ঘটনায় প্রতিপক্ষরা জিয়াউদ্দিন, তাঁর ছেলে ও দুই ভাইয়ের নামে আদালতে মামলা করে। সেই মামলায় জামিন নিতে আজ বৃহস্পতিবার জিয়াউদ্দিন স্বজনদের নিয়ে বগুড়ার আদালতে এসেছিলেন। আদালতে জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর বাসায় ফেরার পথে বড়গোলা এলাকায় দুর্বৃত্তরা তাঁকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে রাজাবাজার এলাকায় দৌড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে জবাই করে হত্যা করা হয় তাঁকে।
উল্লেখ্য জিয়াউদ্দিনের নামে থানায় দুটো মামলা আছে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনাকীর্ণ বাজারে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করা হলেও কেউ প্রতিবাদ করেনি। খুনিরা সবার সামনে দিয়ে বীরদর্পে চলে গেছে। এই খুনের ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। গোয়েন্দা তথ্যে পুলিশ খোঁজে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জমিজমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ধরমপুর এলাকার মিজু, মিশু, সাজু, রিন্টুসহ কয়েকজন দুর্বৃত্ত খুনের ঘটনায় অংশ নিয়েছে।’
বড়গোলা মোড়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশের সামনে থেকে জিয়াউদ্দিনকে ধাওয়া দেওয়া হলেও পুলিশ এগিয়ে আসেনি কেন? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ঈদ ও পূজার কারণে বড়গোলা এলাকাটি জনাকীর্ণ থাকায় পুলিশ ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি।

ঘটনার পরপরই রাজাবাজার এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পরপরই আতঙ্কে ৩ নম্বর রেলগেট থেকে বড়গোলা পর্যন্ত রাজাবাজারের প্রধান সড়কের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে জেলা ও সদর থানা পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল গিয়ে লাশ উদ্ধার করে তা ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠান। বেলা তিনটার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, দত্ত স্টোরসহ আশপাশের সব দোকানপাট বন্ধ। ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে আতঙ্ক। দত্ত স্টোরের সামনে ছোপ ছোপ তাজা রক্ত ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, পুলিশি হয়রানি ও আদালতে সাক্ষী হওয়ার ঝামেলায় তাঁরা আতঙ্কে দোকান বন্ধ করেছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ উপল‌ক্ষে মসলার বাজারের কারণে সকাল থেকেই বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার প্রচণ্ড ভিড় ছিল। বেলা আড়াইটার দিকে বড়গোলা মোড়ের দিক থেকে ছুটে আসছিলেন এক ব্যক্তি। পিছনে ধাওয়া করেছিল ছয়-সাতজন অস্ত্রধারী। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাস্তায় ফেলে লোকটাকে জবাই করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে খুনিরা।
একজন ব্যবসায়ী বলেন, প্রথমে তিনি মনে করেছিলেন কোনো পকেটমারকে মারা হচ্ছে। পরে দেখেন তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। এরপর আতঙ্কে দ্রুত দোকান বন্ধ করেন তিনি।

ধরমপুরের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, স্ত্রী শ্যামলী বেগম স্বামীর শোকে আহাজারি করছেন। ভাতিজা জোবায়ের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তাঁরা স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা করতেন। বসতবাড়ির পাঁচ শতক জায়গা নিয়ে প্রতিবেশী চার ভাই মিজু, মিশু, সাজু, রিন্টুর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। ওই বিরোধের জের ধরে আবদুল করিম নামে তাঁদের এক সহযোগী বাদী হয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে আদালতে চাঁদাবাজি ও মারপিটের মামলা করেন। মামলায় চাচা জিয়াউদ্দিনকে প্রধান আসামি করা হয়। ওই মামলায় গতকাল বুধবার পুলিশ বড় চাচা জাহিদুলকে গ্রেপ্তার করে। বাধ্য হয়ে আজ বৃহস্পতিবার বগুড়ার আদালতে হাজির হয়ে হয়ে সব আসামি জামিনের আবেদন করেন। আদালত সবার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়ার পর আদালত থেকে বাড়ি ফিরছিলেন চাচা জিয়াউদ্দিন। বড়গোলা এলাকায় আসার পর তাঁকে একা পেয়ে প্রতিপক্ষ লোকজন নৃশংসভাবে খুন করে।

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু হায়দার মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান বলেন, ঘটনার পর থেকেই সন্দেহভাজন আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তারা পলাতক। (ওসি) বলেন, মামলা দায়েরের পর আরও জোরালো গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হবে।