কুরিয়ারে বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে মাদক, আসছেও
বাংলাদেশ থেকে বেশি পাচার হচ্ছে ইয়াবা। অন্যদিকে এ দেশে আসছে এলএসডি, খাট, আইসের মতো নতুন মাদক।
তৈরি পোশাকের আড়ালে গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল অ্যামফিটামিন পাচার করছিল একটি চক্র। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ১২ কেজি অ্যামফিটামিন উদ্ধারের পর পাচারের সহযোগিতা করায় একটি বহুজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের তিন কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
পরে অধিদপ্তরের তদন্তেই এই আসামিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তাঁদের সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে এ-ও বলা হয়, মাদক পাচারে কুরিয়ার সার্ভিসের দায় নেই।
অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের ঘটনা ঘটে। ১২ কেজি অ্যামফিটামিন উদ্ধারের ঘটনায় কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের স্ক্যানিং ছাড়াই পার্সেলের চালান বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনায় যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাঁরাই কুরিয়ারে করে মাদকের চালান পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন। এ বিষয়টি এ মামলার অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মাদক পাচার যেমন হচ্ছে, তেমনি একইভাবে বিদেশ থেকে এ দেশে মাদক আসছে। পাচারকারীরা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কুরিয়ারে নতুন নতুন মাদক দেশে আসছে। সর্বশেষ দেশে আসা নতুন মাদক এলএসডি এসেছে একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ারে। আরও দুটি মাদকদ্রব্য খাট ও আইস বা ক্রিস্টাল মেথও একইভাবে দেশে আসে। কুরিয়ার সার্ভিসে মাদক পাচারের অভিযোগে গত এক বছরে ২০টি মামলা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এগুলোর মধ্যে সাতটি মামলা বিচারাধীন। অন্য মামলাগুলোর তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
মামলাগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে ডিএনসি জানতে পেরেছে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাদক পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী মাদক চক্রে জড়িয়ে দেশি-বিদেশি পাচারকারীদের সহায়তা করছেন।
* কুরিয়ারে মাদক পাচারের ঘটনায় ২০ মামলা। * ৭টি বিচারাধীন, বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। * ১৭টি মামলাই হয়েছে ইয়াবা পাচার নিয়ে। * বাংলাদেশি ও বিদেশি নাগরিকেরা জড়িত। * কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
যে ২০টি মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ১৭টি মামলা করা হয়েছে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায়। এর মধ্যে একই চক্রের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। গত বছরের জুনের শুরুতে সৌদি আরবে পাঠানোর সময় এক হাজার ইয়াবা এবং পরে একই মাসে এই চক্রের ২ হাজার ৩০০ এবং ১ হাজার ২৫০টি ইয়াবার দুটি চালান ধরা পড়ে। এতে চক্রের মূল হোতা শাহ আলম এবং তাঁর দুই সহযোগী ইউসুফ মোল্লা ও সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুস সবুর মণ্ডল বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসে মাদকের চোরাচালান রোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পার্সেলে মাদক শনাক্তে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে মাদক পাচারে জড়িত পুরো নেটওয়ার্ক শনাক্তে কাজ চলছে।
পাচারের পেছনে যে কুরিয়ারের কর্মীরাও জড়িত, এর প্রমাণও রয়েছে ডিএনসির হাতে। গত বছরের ১০ আগস্ট আরেকটি বহুজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস থেকে ছয়টি ট্রাভেল ব্যাগভর্তি ৩ হাজার ৫০০ ইয়াবা উদ্ধার করে সংস্থাটি। এই চালান সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছিল। এই ঘটনায় দেশীয় একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কিশোরগঞ্জ শাখার ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান, তাঁর দুই সহযোগী আবু দারদা ও মোজাম্মেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের পর জানা যায়, মোস্তাফিজ আর্থিক সুবিধা নিয়ে ইয়াবা সৌদি আরবে পাচার করছিলেন।
অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিটি শাখায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন ও ফুটেজ সংরক্ষণের জন্য বলা হয়েছে। প্রতিটি বুকিং সেন্টারে স্ক্যানার স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী ও কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ কুরিয়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নেই। যাঁরা নিয়ম মেনে কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনা করছেন, তাঁরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা মেনেই কাজ করছেন। মাদক পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের ধরিয়েও দেওয়া হচ্ছে।
কুরিয়ার সার্ভিসের দায় পায়নি ডিএনসি
কয়েকটি মামলার তদন্তে মাদক পাচারে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও কুরিয়ার সার্ভিসের কোনো দায় বা অবহেলা এখন পর্যন্ত পায়নি ডিএনসি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে ১২ কেজি অ্যামফিটামিন উদ্ধারের যে ঘটনা ঘটেছিল, তখন প্রশ্ন উঠেছিল স্ক্যানিং ছাড়া কীভাবে কার্গো ভিলেজে পার্সেল গেল।
তদন্তে উঠে আসে, এই চালানের গন্তব্য ছিল অস্ট্রেলিয়া। জুনায়েদ আহমেদ সিদ্দিকী নামে এক ব্যক্তি ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা তুজ জোহরা এই চালানের পেছনের মূল ভূমিকা রাখেন। তাঁদের সঙ্গে সতীশ কুমার সিলভারাজ নামের ভারতীয় এক নাগরিকও ছিলেন। এই ঘটনায় সংঘবদ্ধ চক্রের সাতজনকে শনাক্ত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে তদন্তে কুরিয়ার সার্ভিসের কোনো দায় খুঁজে পাননি তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসির পরিদর্শক ফজলুল হক খান বলেন, কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটির স্ক্যানার ছিল না। ম্যানুয়ালি (সনাতন পদ্ধতিতে) তাদের পরীক্ষা করার কথা। তদন্তে ওই মাদক পাচারের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীদের এজাহারে কেন আসামি করা হয়েছিল, জানতে চাইলে মামলার বাদী পরিদর্শক হোসেন মিয়া বলেন, ‘বিমানবন্দরের অন্য একটি সংস্থা আসামিদের আটক করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছিল। এ কারণে তাদের নামে মামলা হয়েছিল।’