করোনা রোগী বাড়তে শুরু করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর সীমান্তবর্তী আরও সাতটি জেলা ‘লকডাউন’ করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। এসব জেলায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের খালি শয্যা প্রায় শেষের পথে। পরিস্থিতি সামলাতে ইতিমধ্যে দুটি জেলায় শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পাঁচটি জেলায় শয্যা বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে।
যে জেলাগুলোতে নতুন করে লকডাউনের সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হলো নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা। এসব জেলায় করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ, নাটোর, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। ফলে জটিল করোনা রোগীদের আইসিইউ সুবিধা থাকা পার্শ্ববর্তী কোনো জেলায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর জেলায় এখনো কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্যতম মুখপাত্র রোবেদ আমিন গতকাল রোববার অনলাইন বুলেটিনে বলেন, করোনার সংক্রমণ কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও এলাকাভিত্তিক তারতম্য দেখা দিচ্ছে।
বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। করোনার বিভিন্ন দেশের ধরনের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ভারতীয় ধরনও বিদ্যমান। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কিছু জায়গায় লোকাল ট্রান্সমিশন (স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ) বেড়েছে।
ঈদুল ফিতরের পর থেকে দেশে পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। দেশে সংক্রমণের ৬৩তম সপ্তাহে (১৬-২২ মে) মোট পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত শনিবার শেষ হওয়া ৬৪তম সপ্তাহে (২৩-২৯ মে) রোগী শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। গতকাল দেশে সংক্রমণের ৬৫তম সপ্তাহ শুরু হয়েছে। এদিন পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।
ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গত বুধবারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৭ থেকে ২৩ মে—এই এক সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় ২২টি জেলায় নতুন রোগী বাড়ার হার শতভাগ বা তার বেশি ছিল। এর মধ্যে ১৫টি জেলাই সীমান্তবর্তী।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) গত শনিবার জানিয়েছিল, দেশে এমন কিছু মানুষ নতুন স্ট্রেইনে (ভারতীয় ধরন) আক্রান্ত হয়েছেন, যাঁদের ভারত ভ্রমণের ইতিহাস নেই। এটা নতুন স্ট্রেইনের সামাজিক সংক্রমণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এদিকে গতকাল আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন জানান, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ২৩টি নমুনায় ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন বুলেটিনে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ২৬৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন বিন্যাস উন্মোচন) করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় ধরন (বি.১.৬১৭) পাওয়া যায়। এসব ধরন ভারতফেরত ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে শনাক্ত হয়। এ ছাড়া ২৭টি নমুনায় যুক্তরাজ্যের ধরন, ৮৫টি নমুনায় দক্ষিণ আফ্রিকান ধরন ও ৫টিতে নাইজেরিয়ান ধরন শনাক্ত হয়।
শয্যা বাড়ানোর চেষ্টা, আইসিইউ নেই
কুষ্টিয়ায় ঈদুল ফিতরের পর ১৮ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ১২ দিনে ১ হাজার ৩৫৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২০২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন ৩ জন। তাঁরা সম্প্রতি ভারত থেকে ফেরার পর সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় ভারত থেকে ফেরা ১৪২ জন বাংলাদেশি তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও তিনটি আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৩৪টি শয্যার বিপরীতে গতকাল করোনায় আক্রান্ত রোগী ছিলেন ২৯ জন। এর মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের সার্বক্ষণিক অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। তবে আইসিইউ নেই। বেশি মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের ১২টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে। তবে ৩টি নষ্ট।
কুষ্টিয়ার করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রোগী বাড়ায় আরেকটি করোনা ওয়ার্ড চালুর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
নাটোরে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। নাটোর সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৩২ শয্যার বিপরীতে গতকাল ২৬ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। সপ্তাহখানেক আগে হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। নাটোরের সিভিল সার্জন কাজী মিজানুর রহমান বলেন, আড়াই শ শয্যার নতুন সদর হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের দোতলাকে করোনা ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
রোগী বাড়তে থাকা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা নেই। এসব জেলার জটিল করোনা রোগীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যশোর জেলায় করোনার জন্য সাধারণ শয্যা ছিল ৪০টি, তা বাড়িয়ে ৮০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। জেলার সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহিন জানিয়েছেন, প্রয়োজনে শয্যাসংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
হাসপাতালভর্তি রোগী, সামলাতে হিমশিম
রাজশাহী মেডিকেলে করোনা রোগী বাড়ায় তাঁদের জায়গা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২৩২টি শয্যা। গতকাল সকালে করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে ভর্তি ছিলেন ২০৯ জন। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭৫ জন। বাকি ১৩৪ জন উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালের ১৫টি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে ভর্তি ১৩ জন।
করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৮ জন করোনায় সংক্রমিত ছিলেন। ৪ জনের করোনার উপসর্গ ছিল। এটিই হাসপাতালে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা। মৃতদের মধ্যে সাতজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের, রাজশাহী ও নওগাঁর দুজন করে চারজন এবং নাটোরের একজন।
হাসপাতালটির উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ওয়ার্ডে জায়গা নেই। তাঁরা নতুন ওয়ার্ড চালুর ব্যাপারে কাজ করছেন।
ঈদের আগে সাতক্ষীরা জেলায় করোনা শনাক্তের হার ছিল ১৩ শতাংশ। ১৬ মে থেকে তা বাড়তে থাকে। এক সপ্তাহ ধরে এ হার ৪০ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৯০ জনকে পরীক্ষা করে ৩৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কুদরত-ই-খোদা বলেন, করোনা রোগীদের জন্য ৯০টি শয্যার বিপরীতে ইতিমধ্যে ১০৮ জন রোগী ভর্তি করা হয়েছে। রোগী নিয়ে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন।
খুলনায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের ১০০ শয্যায় গতকাল সকালে ৯৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। আইসিইউতে ছিলেন ১১ জন। হাসপাতালের ফোকাল পারসন সুহাস রঞ্জন হালদার প্রথম আলোকে বলেন, রোগীর চাপ আরও বাড়লে করোনা ইউনিট-২ চালু করার জন্য প্রস্তুতি আছে। আইসিইউ শয্যা ১০টি থেকে বাড়িয়ে গতকাল ২০টি করা হয়েছে। পাশাপাশি ১০ শয্যার এইচডিইউ (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট) চালু করা হয়েছে।
ঠিকমতো অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না
চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেনের অভাব। সদর হাসপাতালে করোনা ইউনিটের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক নাহিদ ইসলাম জানান, সেখানে করোনা রোগীদের জন্য ১৯টি শয্যা রয়েছে। সব শয্যায় এখন রোগী ভর্তি। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তির মতো অবস্থা নিয়ে রোগী আসছেন। কিন্তু নতুন রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৬০টি অক্সিজেন সিলিন্ডারের মধ্যে ৩০টি ব্যবহার করা যায়, বাকি ৩০টি অক্সিজেন ভরে আনার জন্য পাঠাতে হয়। কিন্তু ঠিকমতো অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ঠিকমতো দিতে পারছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নাটোরে অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে থাকা স্পেকট্রার কর্মকর্তা মীর আখতারুল প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ রোগী বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে। সব জায়গায় বাড়তি অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুটা সময় লেগে যাচ্ছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]