সর্বজনীন স্বার্থে রাষ্ট্রের সামর্থ্য বাড়াতে হবে
কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষয়ক্ষতি বেশ কিছুদিন ধরে হতে থাকবে। কথা হচ্ছে ক্ষতির মাত্রা কতটা কমানো যায়। এমন অবস্থায় সংগত-অসংগত নানা রকমের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের মধ্যে পুরোপুরি আটকে না থেকে কোথাও কোনো আলোর রেখা আছে কি না, তার খোঁজ করাটা সম্ভবত মন্দ হয় না।
করোনার তোড়ে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির চাল-চরিত্র পাল্টে যাওয়া নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। বেশির ভাগ কথাবার্তাই নেতিবাচক। বলা হচ্ছে যে করোনার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নজরদারি আরও বাড়বে। সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা বাড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা ইত্যাদি ব্যবহার করে নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি বাড়বে। তার ফলে নাগরিকদের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে। এসব বক্তব্য জর্জ অরওয়েলের ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ কিংবা মিশেল ফুকোর ‘প্যান-অপটিসিজম’-এর মতো ধারণাগুলোর স্বাভাবিকীকরণের পূর্বাভাস দেয়।
ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়তে থাকা নিয়ে কথাবার্তা চলছে অনেক দিন ধরে। করোনা পর্বে নানা রকমের প্রবণতা দেখে এই আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রকে একমাত্র নষ্টের গোড়া হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্যে বড় বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তির ওপর নজরদারি কি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো ছাড়া আর কেউ করে না? গুগলে ঢুকে একবার সার্চ বক্সে ধরা যাক ‘ঢাকা টু লন্ডন চিপ ফ্লাইটস’ কিংবা ‘চিপ হোটেলস ইন দুবাই’ কথাগুলো লিখি। এ রকম কয়েকবার এই কাজটা করি। কিংবা কোথাও একটা ফ্লাইট বা হোটেল বুক করি। তারপর কী দেখব? অচিরেই আমার মেইলবক্সে এই বিষয়ে বিজ্ঞাপন আসতে থাকবে। এটা কি এমনি এমনি হয়? এটা কি নজরদারি নয়? বলা হতে পারে যে রাষ্ট্রের এ ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে হয়রানি করা ও শাস্তি দেওয়ার মতো ব্যাপারগুলো থাকতে পারে। কথা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে হয়রানি ও শাস্তির ব্যাপারগুলো না থাকলেও অন্য কোনো পক্ষ এসব কাজ করে না।
মন্দ দিক এক পাশে সরিয়ে রেখে একটু দেখা যাক করোনা সংকট থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের চরিত্রে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তনের সুযোগ আছে কি না। ইতিহাস কিন্তু সাক্ষ্য দেয় যে মহাবিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র কখনো-কখনো মহা সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহাবিপর্যয়ের পরের ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি। ফ্রান্সের ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘গৌরবময় ত্রিশ বছর’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটিতে ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ১৭৫ ভাগ। এই সময়ে উচ্চ উৎপাদন, উচ্চ মজুরি, উচ্চ ভোগ, উচ্চমানের সামাজিক সুবিধাদি, উচ্চ জীবনমান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কারণ কী? অন্যতম কারণ যুদ্ধের পরে ফ্রান্স রাষ্ট্র সবকিছু মুনাফাসর্বস্ব বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে পুঁজিবাদের বেয়াড়া ঘোড়াটির লাগাম নিজের হাতে নিয়েছিল। এই কাজটা পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ব্রিটিশদের প্রকাশ্য গর্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। দেশটির সব নাগরিক, এমনকি সে দেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের জন্যও বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছে এনএইচএস। এটা চালু হয় ১৯৪৮ সালে। অর্থাৎ এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাজ্যের জাতীয় অর্থনীতি তলানিতে। এমন দুঃসময়েই রাষ্ট্রের পরিচালকেরা সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।
জার্মানির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ। শুধু তাই নয়, খোদ রাষ্ট্রটিই দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে। জাতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত, জাতির মনে পরাজয়ের হতাশা। পূর্ব জার্মানি সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে; সে ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই মূল শক্তি ও উদ্যোক্তা। পুঁজিতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানির দুর্দশা ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় শোচনীয়। কীভাবে কী করতে হবে তা ঠিক করে দেয় পুঁজিবাদী দুনিয়ার নয়া মুরব্বি আমেরিকা। এর মধ্যেও কিন্তু পশ্চিম জার্মানি রাষ্ট্র নিজের নিশানা ঠিক করে নেয়; চালু করে সোশ্যাল মার্কেট ইকোনমি। রাষ্ট্র নিশ্চিত করে, যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে সৃষ্ট টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন বাজারে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারে; কতিপয় প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে পণ্য বা সেবার দাম নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্র শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা জাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ফলে দেশটির অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই।
সুতরাং, ইতিহাস বলছে, গুরুতর দুর্যোগের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র ইতিবাচক পথে যাত্রা শুরু করতে পারে। সে জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের আন্তরিক তৎপরতা থাকতে হয়। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সামনে তেমন সুযোগ নিয়ে এসেছে। যেমন এই মহামারিতে আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে জনস্বাস্থ্য খাতে
বাজেট অনেক বাড়িয়ে দেশের সব নাগরিকের জন্য সুলভে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ভাবনা খুব বাড়াবাড়ি হবে? নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চেপে বসা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। তাই বলে বাজারকে ঈশ্বর বানিয়ে রাষ্ট্রকে অপাঙ্্ক্তেয় করার নব্য উদারনীতিবাদী কর্মকাণ্ডও সমর্থন করা যায় না। করোনা এই উপলব্ধির সুযোগ সামনে এনে দিয়েছে। হাজার হাজার আইসিইউ, শত শত ভেন্টিলেটর, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, গণসচেতনতা সৃষ্টির মতো কাজগুলোতে কোন দেশে ব্যক্তিগত খাত মূল দায়িত্ব পালন করছে? ব্যক্তিগত খাত চাইলে সহায়তার হাত বাড়াতে পারে। কিন্তু না চাইলে কী করার আছে?
করোনার আঘাতে রাষ্ট্রগুলো যেন আঠারো-উনিশ শতকে ফিরে গেছে। দু-তিন মাস ধরে কেউ কাউকে চেনে বলে মনে হচ্ছে না। ভেন্টিলেটর থেকে ভ্যাকসিন সবকিছু যেন একা একা ম্যানেজ করতে চাইছে; যে যার মতো বাঁচতে চাইছে। এভাবে বাঁচতে চাওয়া আসলে মরতে যাওয়া। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভাইরাসের ঢুকে পড়া ঠেকানোর কোনো রাস্তা কি ছিল? যত নিশ্ছিদ্র সীমান্ত, ইমিগ্রেশন ইত্যাদির কথা বলা হোক না কেন? নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মেক্সিকোর সীমান্ত বরাবর শত শত মাইল দেয়াল তোলা হবে অনুমতিহীনদের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য? করোনা থেকে যাবতীয় মতাদর্শের রাষ্ট্রই এই শিক্ষাটা নিতে পারে যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই।
শান্তনু মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক