শয্যা পেতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে

রাজধানীর ১৩টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৯টিতেই কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই।

স্কুলশিক্ষক হাফিজুর রহমানের এই ছবি গতকাল দুপুরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তোলা। তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় তাঁকে এখানে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছিলেন ছেলে মো. ফারুক। শয্যা খালি না থাকায় তাঁরা সেখান থেকে যাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর ভর্তি হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ছবি: দীপু মালাকার

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একটি সাদা বোর্ড রাখা। তাতে লেখা, ‘বেড খালি নাই’। অবশ্য বোর্ডে কী লেখা তা দেখার সময় নেই করোনায় আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের। করোনার উপসর্গ রয়েছে ও আক্রান্ত-এমন চারজন রোগীকে গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টার মধ্যে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের বহু অনুরোধের পরও শেষ পর্যন্ত ভর্তি করাতে না পেরে রোগী নিয়ে অন্য জায়গায় ছুটতে হয়েছে তাদের।

ভর্তি হতে না পেরে ফিরে যাওয়া রোগীদের একজন খিলগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান। অ্যাম্বুলেন্সে করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যখন তাঁকে আনা হয়, তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। হাফিজুরের ছেলে মো. ফারুক হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নানাভাবে অনুরোধ করলেও কোনো শয্যা খালি না থাকায় ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাবাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন ফারুক। হাসপাতালে পৌঁছার পর জরুরি বিভাগের একটি কক্ষে বাবাকে রেখে তিনি ছুটে যান ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। মাঝে একবার বাবার অবস্থা দেখতে সেখানে আসেন। ওই কক্ষে ঢুকেই দেখেন তাঁর মা চিৎকার করে কাঁদছেন। ফারুকের আর বুঝতে বাকি থাকে না সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তাঁর বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

ফারুকের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামে। বিকেলের পর পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে রওনা হন গ্রামের উদ্দেশে। গত রাত সাড়ে ৯টায় মাওয়া ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় থাকা ফারুক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখের সামনে বাবা মরে গেল। অথচ হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলাম না।...(কান্না)’

গতকাল দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গত ১৬ মাসের মধ্যে এই প্রথম এক দিনে রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়াল।

সংকটাপন্ন করোনা রোগী এসে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা নতুন রোগী ভর্তি নিতে পারছি না। আমরা যদি আর কোনো রোগী ভর্তি করি, তাহলে এখন হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি আছে, তাঁদের অনেকে অক্সিজেন পাবেন না। বাধ্য হয়ে এ মুহূর্তে নতুন করে রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ৩টি হাসপাতালে আইসিইউ নেই। বাকি ১৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৯টি হাসপাতালেই গতকাল কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না। বাকি চারটি হাসপাতালে ফাঁকা ছিল ৯টি আইসিইউ। আর সারা দেশে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৩১২টি। এর মধ্যে ১ হাজার ১২১টিতে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল।

ঢাকার বাইরে সিলেটেও শয্যা পেতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে করোনা রোগীদের। করোনা উপসর্গ নিয়ে সম্প্রতি সিলেটের সোবহানীঘাট এলাকার বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন আবু তালেব (৫৮)। গতকাল সকালে তাঁর নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন করোনা পজিটিভ আসে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় দুপুরের দিক থেকে তাঁর জন্য আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে ছোটাছুটি শুরু করেন স্বজনেরা। তাঁর স্বজন ইউনুস আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন। কোথাও আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তাই আপাতত সিলিন্ডার অক্সিজেন দিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে। দ্রুত আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা না করতে পারলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার নর্থ ইস্ট হাসপাতালের বিপণন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁদের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় ৩২টি আইসিইউ শয্যা এবং ৬৮টি সাধারণ শয্যা রয়েছে। সব কটিই এখন রোগীতে পরিপূর্ণ। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা অনেককে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।

সিলেটের আখালিয়া এলাকার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের বিপণন কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম জানান, তাঁদের হাসপাতালে ৯টি আইসিইউ শয্যাসহ মোট ৬৪টি শয্যা রয়েছে। সব কটিই রোগীতে পরিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘গত সোমবার আমার স্ত্রীকেও আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। পরে তাঁর আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু শয্যা খালি পাননি। পরে একজন রোগী মারা যান। এরপর মঙ্গলবার রাতে আমার স্ত্রীকে আইসিইউ শয্যায় স্থানান্তর করতে পেরেছি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সাতটি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২২টি। এর একটিও গতকাল খালি ছিল না। চট্টগ্রামে সরকারি চারটি হাসপাতালের আইসিউ শয্যা আছে ৩৩টি। এর মধ্যে ২৫টি আইসিউ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। খুলনা বিভাগে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৭৭টি। এর মধ্যে মাত্র চারটি শয্যা খালি ছিল। রাজশাহী বিভাগের ১০টি সরকারি হাসপাতালে ৫৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি ছিল মাত্র ৯টি। বরিশাল বিভাগের সাতটি সরকারি হাসপাতালে ৩৩টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি ছিল ১১টি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য ও বাস্তবতা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা খালি দেখানো হয়েছে ৭৫টি। তবে শয্যা খালি নেই উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার বিকেলেই নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরে এই হাসপাতালে স্ত্রী নাসরিন সুলতানাকে ভর্তি করাতে এসেছিলেন আবদুর জাহেদ। করোনায় আক্রান্ত স্ত্রীকে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে মোটরসাইকেলে করে এখানে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, শয্যা খালি না থাকায় ভর্তি করানো সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নাসরিনকে আবার নিজের শরীরের সঙ্গে ওড়না দিয়ে বেঁধে জাহেদ মোটরসাইকেলে করে রওনা হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দিকে। সেখান থেকেও তাঁকে ফিরতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, শয্যা খালি নেই।

দুই হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে করোনায় আক্রান্ত স্ত্রী নাসরিনকে নিয়ে আরেক হাসপাতালের পথে স্বামী আবদুর জাহেদ। গতকাল রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে।
ছবি: প্রথম আলো

পরে জাহেদ একজনের কাছে জানতে পারেন, মহাখালীর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে শয্যা খালি আছে। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান মহাখালীতে। সেখানে স্ত্রীকে ভর্তি করাতে সক্ষম হন তিনি।

আবদুর জাহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি সাধারণ শয্যা পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তা যেন আর কারও না হয়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে, বিএসএমএমইউতে শয্যা খালি দেখানো হয়েছে ৩৪টি। তবে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্সিজেন প্রয়োজন হবে, এমন রোগীকে এ মুহূর্তে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের শয্যার মিল না পাওয়ার বিষয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শয্যা ফাঁকা বা পূর্ণ থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দেওয়া। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানায়। আর যে তথ্য প্রতিদিন অধিদপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তা ২৪ ঘণ্টা আগের তথ্য।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা রয়েছে ৭০৫টি। সেখানে গতকাল চারটি শয্যা ফাঁকা থাকার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা রোগীর চাপ এতই বেড়েছে যে সাধারণ শয্যাতেও রোগী ভর্তি করানো কঠিন হয়ে গেছে। পুরোনো রোগী ছাড়ার পর নতুন রোগী নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সব সময় শয্যা পরিপূর্ণ থাকছে। আর আইসিইউ শয্যা তো কোনো সময় খালি থাকছে না।’

ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের গতকাল শয্যা খালি দেখানো হয়েছে ৪৭৩টি। তবে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের যে শয্যাগুলো খালি আছে, সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ নেই। সার্বক্ষণিক অক্সিজেন লাগবে, এমন রোগীদের ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।