লকডাউন নয়, ফোর-টি-তে বাজিমাত দক্ষিণ কোরিয়ার
উত্তর-পূর্ব এশিয়ার গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। এখানকার সবচেয়ে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পিএইচডি এবং পোস্টডকসহ ভালো গবেষণাপত্র এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশটির বড় কোনো পরিকল্পনা বা সংকটকালীন স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের জন্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব মেধাবী শিক্ষক এবং গবেষকের মতামত গ্রহণ করে, কোনো আমলা কিংবা রাজনৈতিক নেতার মতামত নয়। মূলত শিক্ষক-গবেষকেরাই সরকারকে সংকট মোকাবিলার মডেল তৈরি করে দেন, সরকার শুধু সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করে।
সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কোনো প্রকার লকডাউন ছাড়াই দেশটি এখন পর্যন্ত অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিছুদিন আগেও যেখানে প্রতিদিন দেশটিতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি ছিল, চীনের পরে করোনাভাইরাসের epicenter হতে বসেছিল, সেই দেশটিতে এখন নতুন করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য! মোট আক্রান্তের বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এ অসামান্য অবদানের জন্য দেশটির সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (Center for Disease Control) প্রধান, জুং ইউন কেওংকে (Jung Eun-Kyeong) ‘ন্যাশনাল হিরো’ খেতাব দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্ব যেখানে করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত, সেখানে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়ার এই সফলতার রহস্য কী?
প্রথমত, তাদের সফলতার মূল জায়গা ২০১৫ সালের MERS ভাইরাস থেকে শিক্ষা নেওয়া। ২০১৫ সালে MERS ভাইরাস সংক্রমণের সময় একজন কোরিয়ান ব্যবসায়ী মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোরিয়ায় আসেন। পরে তিনি অসুস্থবোধ করায় তাঁকে তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপরে শনাক্ত করা যায় যে তিনি MERS ভাইরাসে আক্রান্ত। তত দিনে তাঁর থেকে MERS–এর চেইন সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। বিশেষত সেই হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্স, স্টাফ, অন্যান্য রোগী অনেকেই আক্রান্ত হয়। তখন সেই MERS ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে দক্ষিণ কোরিয়াকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে সংক্রামক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার আলাদা ইউনিট করা হয়। তারা বুঝতে পারে সংক্রামক রোগ দমনের জন্য প্রথম ডাক্তার, নার্স, হেলথ প্রফেশনালিস্ট এবং হাসপাতালের সুরক্ষা প্রয়োজন। কারণ, এদের কেউ আক্রান্ত হলে তাদের মাধ্যমে সেটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়া তারা উপলব্ধি করে যে সংক্রামক রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব বেশি বেশি পরীক্ষা করে শনাক্ত করে আলাদা (isolation) করতে পারবে, তত দ্রুত সংক্রামক রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
তাই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়া লকডাউন স্ট্র্যাটেজিতে না গিয়ে ফোর টি (4T) স্ট্র্যাটেজিতে যায়। Test, Tracking, Tracing and Treatment. চীনের উহানে যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তাদের অধ্যাপক-গবেষকেরা করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। প্রথমেই দেশটির ডাক্তার, নার্স, হেলথ প্রফেশনালিস্টদের জন্য শতভাগ সুরক্ষা পোশাক (PPE) নিশ্চিত করা হয়। তাদের উৎসাহ প্রদান করা হয়। কোরিয়া সরকার ডাক্তারদের এতটাই সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে যে দাবি করা হচ্ছে এখন পর্যন্ত কোরিয়ায় কোনো ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি!
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের যোদ্ধাদের ঢাল-তলোয়ার দিয়ে প্রস্তুত করার পর তারা দ্রুত করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট তৈরিতে মনোযোগী হয়। গবেষণানির্ভর দেশ হওয়ায় তাদের অনেক বিশ্ববিখ্যাত বায়োটেকনোলজি কোম্পানি আছে। চীনের উন্মুক্ত করে দেওয়া করোনাভাইরাসের কমপ্লিট জিনোম সিকোয়েন্স থেকে তারা দ্রুত করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট তৈরি করে ফেলে। সারা দেশে ৬০০–এর বেশি করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার স্যাম্পল টেস্ট করা সম্ভব!
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল, টেস্ট কিটসংবলিত যোদ্ধা এবং যুদ্ধের উপকরণ তৈরি করা শেষে দক্ষিণ কোরিয়া শুরু করে আসল যুদ্ধ। প্রথমেই তারা চীনফেরত এবং করোনার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়াদের পরীক্ষা শুরু করে। এর মধ্যে যাদের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়, তাদের কন্ট্যাক্ট ট্র্যাকিং এবং ট্রেসিং করে গত ১৪ দিনে তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের সবাইকে দ্রুত টেস্ট করে। সবকিছু কন্ট্রোলে থাকলেও ৩১তম রোগী হাসপাতাল থেকে চার্চ গমনের মাধ্যমে ক্লাস্টার সংক্রমণ শুরু হয়। সেটিকে কন্ট্রোলে আনতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
তবু সরকার লকডাউনে না গিয়ে দ্রুত আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে করোনা টেস্ট করে। লোকেশন ট্র্যাকিং এবং ট্রেসিংয়ের জন্য সরকার আইডি কার্ড, ব্যাংক কার্ড, মোবাইল সিম, সিসিটিভি ফুটেজ ইত্যাদি তথ্য ব্যবহার করে। খুব দ্রুত বেশির ভাগ সন্দেহভাজনের করোনা টেস্ট করিয়ে তাদের আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন করে ফেলে। কোনো প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা তথ্য গোপন ছাড়াই প্রতিদিনের নতুন আক্রান্ত, মৃত এবং সুস্থ সংখ্যা নিয়মিত ব্রিফিং করে জানানো হয়। করোনা রোগীর অবস্থান জানার জন্য Corona 100m নামে মোবাইল অ্যাপস চালু করে। করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ১০০ মিটারের মধ্যে এলেই অ্যাপস আপনাকে অ্যালার্ম দেবে।
আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের ব্যবহার করা টিস্যু এবং বর্জ্য ফেলার জন্য আলাদা ব্যাগ দেওয়া হয়, যেটি স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্দিষ্ট সময় পরপর গিয়ে সবার বাসা থেকে নিয়ে এসে ভালোভাবে পুড়িয়ে ফেলেন। এ ছাড়া তাঁদের সার্বক্ষণিক অবস্থান জানার জন্য এবং তাঁরা কখনো নির্দিষ্ট রুমের বাইরে যাচ্ছেন কি না, সেটি জানার জন্য মোবাইলের জিপিএস চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রয়োজনে তাঁদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়।
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ক্যাটাগরি করা হয়। রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক প্রাধান্য নয়, অসুস্থতার ভিত্তিতে সেবাদান নিশ্চিত করা হয়। বেশি অসুস্থদের ভালো হাসপাতালে এবং অপেক্ষাকৃত কম অসুস্থদের সাধারণ হাসপাতাল এবং ডরমিটরিতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কোরিয়ার স্যামসাং, হুন্দাইয়ের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডরমিটরিকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে সরকারকে দেয়। উন্নত চিকিৎসাসেবার কারণে কোরিয়ার সুস্থ হওয়ার হার ৭০ ভাগের বেশি, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশের সব মানুষও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা করে। নিয়মিত মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার, স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে থাকাসহ সব প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকার এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাত্র দুই মাসের মধ্যে কোরিয়ায় নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা এখন শূন্য।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কোরিয়ান 4T স্ট্র্যাটেজি সারা বিশ্বে এখন প্রশংসিত। জাতিসংঘের মহাসচিব কোরিয়াকে মডেল দেশ উল্লেখ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সব দেশকে কোরিয়াকে অনুসরণের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকেরা দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারে।
*লেখক: পোস্ট ডক্টরাল গবেষক, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।