রোগী বাড়ছে, অক্সিজেন নিয়ে শঙ্কা
চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ। কোনো কোনো জেলায় বেড়েছে কয়েক গুণ। উৎপাদন, আমদানি, পরিবহন, সরবরাহ মিলে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় আছে বড় ঘাটতি।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় অক্সিজেনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। এখন পর্যন্ত অক্সিজেনের সংকট না থাকলেও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়ে গেছে। আরও রোগী বাড়তে থাকলে অক্সিজেন সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার জন্য আপত্কালীন একটি জরুরি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
এরই মধ্যে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে করোনা রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা ও বগুড়ায়। অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, অক্সিজেনের মজুত থাকলেও তা সরবরাহে দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি। বর্তমানে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য ট্যাংকারের অভাব আছে। অধিকাংশ হাসপাতালে সেন্ট্রাল পাইপলাইনে স্বাভাবিক সক্ষমতার চেয়ে এখন বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হলে সময়মতো অক্সিজেন পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ আছে। দক্ষ জনশক্তিরও ঘাটতি আছে।
এই পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ কমানোকে সবচেয়ে জরুরি মনে করছেন অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এ বি এম মাকসুদুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। কোনো দেশ তা পারেনি। তাই সংক্রমণ কমানোর পাশাপাশি অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়া খুব দরকার।
সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই ১৭ জেলায়
অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন রোগীর মিনিটে ১৫ লিটারের মতো অক্সিজেন দরকার পড়লে তা সিলিন্ডার থেকে সরবরাহ করা যায়। আবার সিলিন্ডার না থাকলে বিকল্প হিসেবে এ চাহিদা পূরণ করতে পারে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। এটি বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রোগীকে সরবরাহ করে। আর মিনিটে ৩০ লিটারের মতো অক্সিজেন লাগলে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ব্যবহার করা হয়। এটির জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন পাইপলাইন দরকার হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র চালাতেও দরকার সেন্ট্রাল অক্সিজেন পাইপলাইন।
গত বছর করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। মাঝে করোনা সংক্রমণ কমে আসায় কাজের গতিও কমে। বর্তমানে দেশের ১৭টি জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই বলে নিশ্চিত করেছেন প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধিরা। এসব এলাকায় প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করছে ইউনিসেফ।
ইউনিসেফের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মোট ৩০টি হাসপাতালে প্ল্যান্ট বসানোর কাজ করছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে পাঁচটির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দুটি চালু হয়েছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি পেলে বাকি তিনটি এ সপ্তাহে চালু হবে। আর ১১টির কাজ প্রায় শেষের দিকে। বাকি ১৪টির পাইপলাইন বসানোর কাজ হয়েছে। ভারত থেকে ট্যাংক এলেই তা স্থাপনের কাজ শেষ হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের কার্যাদেশ দিতে এক বছর দেরি না করলে অনেক আগেই কাজ শেষ হতো। এখন যেসব এলাকায় রোগী বাড়ছে, সেখানে আগে কাজ শেষ করছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, এখানে সরকারি কাজের প্রতিটি ধাপে নজরদারির লোকের অভাব আছে। শক্ত ফলোআপের ব্যবস্থা থাকা দরকার। সংকটময় সময় সামনে, তাই সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।
চাহিদা বাড়ছে হু হু করে
প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে খুলনা বিভাগে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিনে চাহিদা ছিল ৩৫ থেকে ৪০টি সিলিন্ডার। এখন প্রায় ৩৫০টি সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া অক্সিজেন ট্যাংক নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মুখপাত্র কাজী আবু রাশেদ জানান, ৬ হাজার লিটারের ট্যাংক আছে। এখন প্রতি সপ্তাহে একবার ভরতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে দুই মাসে একবার ভরতে হতো।
চুয়াডাঙ্গায় দিনে চাহিদা ছিল ১০০ থেকে ২০০ লিটার অক্সিজেন। এখন এটি দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার লিটারে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কুদরত-ই-খোদা বলেন, দিনে দেড় হাজার লিটারের চাহিদা ছিল। এখন যাচ্ছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার লিটার।
ফরিদপুরে দেড় হাজার থেকে বেড়ে দিনের চাহিদা এখন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লিটার।
সর্বোচ্চ সরবরাহ হচ্ছে এখনই
করোনার সংক্রমণের আগে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন। ওই সময় আমদানির প্রয়োজন হতো না। দিনে এখন সারা দেশে অক্সিজেনের চাহিদা ২০০ থেকে ২২০ টন। এর আগে গত এপ্রিলের শুরুতে এমন চাহিদা ছিল। ওই সময় ১০০ টন আসত পাশের দেশ ভারত থেকে। বাকিটা দেশেই উৎপাদিত হয়েছে।
২১ এপ্রিলের পর ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। রোগী কমে আসায় সংকট তৈরি হয়নি। এখন রোগী বাড়তে শুরু করায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিল্পে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রেখে পুরোটাই স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া হচ্ছে এখন। কিছু আমদানিও শুরু হয়েছে ভারত থেকে।
দেশে বর্তমানে মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এর মধ্যে লিন্ডে বাংলাদেশ দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন পর্যন্ত সরবরাহ করছে। দেশে তাদের নিজস্ব উৎপাদনক্ষমতা ৯০ টনের মতো। বাকিটা ভারতে তাদের নিজস্ব কারখানা থেকে এনে সরবরাহ করছে। প্রয়োজনে আবুল খায়ের গ্রুপের কাছ থেকেও কিনছে তারা।
স্পেকট্রা অক্সিজেনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দিনে ৫০ টনের বেশিও সরবরাহ করেছেন তাঁরা। নিজেরা উৎপাদনের পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি ও চট্টগ্রামের দুই শিল্প গ্রুপের কাছ থেকে কিনে সরবরাহ করেন তাঁরা।
দিনে ৪০ টনের মতো অক্সিজেন সরবরাহ করছে ইসলাম অক্সিজেন কোম্পানি। বেসরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে তারা। ইসলাম অক্সিজেন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে। রোগী বাড়লে কী হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি হাসপাতালে দিনে গড়ে সাড়ে তিন টন অক্সিজেন লাগে। তাই দেশে উৎপাদন বাড়ানো দরকার। তিনটি প্রতিষ্ঠান চরম চাপের মধ্যে কাজ করছে। কোনো একটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেই ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোথাও অক্সিজেনের ঘাটতি নেই। ভারত থেকে আমদানি শুরু হয়েছে। আমদানি ও দেশীয় সক্ষমতার উৎপাদন অব্যাহত থাকলে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না।
শিল্পের অক্সিজেনও হাসপাতালে
৫১০ টন উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও স্বাস্থ্য খাতে দিনে ৫৫ টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে চট্টগ্রামের দুই শিল্প গ্রুপ আবদুল খায়ের ও জিপিএইচ ইস্পাত। এর মধ্যে আবুল খায়েরের কাছ থেকে অক্সিজেন কিনে নেয় লিন্ডে ও স্পেকট্রা। ২০ থেকে ২৫ টন বিক্রি করছে তারা। এ ছাড়া প্রতিদিন ৫০০ সিলিন্ডারে করে অক্সিজেন সরবরাহ করছে আবুল খায়ের।
আবুল খায়ের স্টিল প্ল্যান্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দিনে ৩০ টন সরবরাহ করা যাবে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। আর সিলিন্ডারে সরবরাহ বাড়াতে নতুন করে যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দিনে ২৫ টনের মতো অক্সিজেন সরবরাহ করছে জিপিএইচ ইস্পাত। তাদের কাছ থেকে কিনে নেয় স্পেকট্রা অক্সিজেন। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে সিলিন্ডারে করে বিনা মূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করছে তারা। জিপিএইচ ইস্পাতের অক্সিজেন প্ল্যান্টের একজন কর্মকর্তা জানান, গতকালও বিভিন্ন হাসপাতালে বিনা মূল্যে ১০০ সিলিন্ডার অক্সিজেন সরবরাহ করেছেন তাঁরা।
তবে অক্সিজেন সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিবহন এখনো একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন জেলায় ট্যাংকারে করে নিয়মিত অক্সিজেন পাঠাতে হচ্ছে। তাই ট্যাংকারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সুযোগ থাকলেও ট্যাংকারের অভাবে ভারত থেকে বেশি করে অক্সিজেন আনতে পারছে না লিন্ডে।
দেশে এক সপ্তাহ ধরে গড়ে প্রতিদিন ৮ হাজারের বেশি নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে সরবরাহকারীরা।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত সংবাদ বুলেটিনে বলা হয়, বর্তমানে অক্সিজেনের উৎপাদন ও সরবরাহে কোনো সংকট নেই। তবে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সেটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অবহেলা করা হয়েছে। এখন অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার জন্য আপত্কালীন একটি জরুরি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।