দেশ করোনা সংক্রমণের ছয় মাস পার করল। এই ছয় মাসে মহামারি মোকাবিলায় পরিকল্পিত কাজের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতে নেতৃত্বের দুর্বলতা ও দুর্নীতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। মহামারি নিয়ে মানুষের মধ্যে আছে গভীর অনিশ্চয়তাও।
মহামারির ব্যাপারে বিশ্বের কোনো দেশ প্রস্তুত ছিল না। তারপরও বাংলাদেশ প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেয়েছিল। বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক তৌফিক জোয়ারদার প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভাইরাসের সংক্রমণের সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল গত বছর ডিসেম্বরের শেষে। বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। বাংলাদেশ দুই মাসের বেশি সময় পেয়েছিল প্রস্তুতি নেওয়ার। সেই সময় বাংলাদেশ কাজে লাগায়নি, প্রস্তুতি নেয়নি, পরিকল্পনা করেনি। তাঁর মতো অনেকেই বলছেন, সরকার উদ্দেশ্যহীনভাবে ছয়টি মাস পার করেছে। শুরুর সমন্বয়হীনতা এখনো দূর হয়নি, বরং কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা অতীতের মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলছেন, মহামারি চিরস্থায়ী হয় না। একটি সময় পর মহামারির প্রকোপ কমে, দুর্বল হয়। যদিও বিশ্বের সব দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সমানভাবে দেখা দেয়নি। কিছু দেশে প্রকোপ কমে যাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জনবহুল বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রকোপ তেমন প্রবলভাবে দেখা দেয়নি। করোনায় মৃত্যুও তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশে কেন সংক্রমণ বা মৃত্যু কম, এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা জনস্বাস্থ্যবিদদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে গত দুই সপ্তাহে সংক্রমণ ও গত এক সপ্তাহে মৃত্যু কম হতে দেখা যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ তৌফিক জোয়ারদার বলেন, কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে সরকার মহামারির বিষয় অনেকটাই প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এই ভাইরাস আপনা-আপনি দূর হবে না।
চলমান সমন্বয়হীনতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারির শুরুতে বলেছে, মহামারি মোকাবিলা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়, একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। গোটা সরকারব্যবস্থাকে এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। কাজে থাকতে হবে সমন্বয়। দেশে বারবার এর ঘাটতি দেখা গেছে।
মহামারি মোকাবিলার প্রথম বড় কাজ নজরে পড়ে ১ ফেব্রুয়ারি। এই দিন চীন থেকে ৩১২ প্রবাসীকে বাংলাদেশে আনা হয়। কিন্তু আশকোনা হজ ক্যাম্পে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করা নিয়ে নানা সমস্যা ও অভিযোগের কথা শোনা যায়। তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কার্যকর সহায়তা তাঁরা পাননি।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার এ রকম আরও নজির ছয় মাসে দেখা গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই কাজে সমন্বয় দেখা যায়নি। কোন হাসপাতাল কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হবে, তা নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
অতিসম্প্রতি অ্যান্টিবডি পরীক্ষার পক্ষে মত দিয়েছে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। অন্যদিকে দেশে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার সরকারের পরিকল্পনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, শুল্ক কে দেবে, তা নির্দিষ্ট না থাকায় এই জরুরি সময়ে এক মাসের বেশি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) ও অক্সিজেন পরিমাপের যন্ত্র আটকে আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, এসব সামগ্রী ছাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতিও সামনে এসেছে
সমন্বয়হীনতার ঘটনার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি সামনে চলে আসে। একটি প্রতিষ্ঠান ‘এন-৯৫’-এর নাম করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নকল মাস্ক সরবরাহ করেছিল মার্চের শেষ সপ্তাহে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এর প্রতিবাদ করেন। মাস্ক নিয়ে দুর্নীতির এই সংবাদ ২ এপ্রিল প্রকাশ করে প্রথম আলো।
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। তবে করোনাকালে দুর্নীতিও মহামারির চেহারা নেবে, এটা অনেকেরই চিন্তার বাইরে ছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনা নিয়ে এত দুর্নীতি বিশ্বের আর কোনো দেশে হয়নি।
এপ্রিলের শুরু থেকে নিয়মিতভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। করোনা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ হাসপাতালের বাইরে আসতে থাকে। হাসপাতালেও মৃত্যু বাড়তে থাকে। একাধিক হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এ রকম একাধিক ঘটনায় মানুষের মধ্যে ভয়-সংশয় দানা বাঁধতে থাকে। মানুষ জানতে পারে হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। হাসপাতালে অক্সিজেন-সংকটের সংবাদ বের হয়। এসব সংবাদকে পেছনে ঠেলে গণমাধ্যমে জায়গা করে নেয় জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি।
করোনা নিয়ে এত দুর্নীতি বিশ্বের আর কোনো দেশে হয়নি।
নিয়মনীতি ও আইন অনুসরণ না করে এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষা ও করোনা রোগীর চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরে জানা যায়, এসব ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতিও হয়েছে। তখন টিআইবি বলেছিল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া এই দুর্নীতি সম্ভব নয়।
দুর্নীতি হয়েছে দাতাদের অর্থে পরিচালিত প্রকল্পেও। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে করোনা মোকাবিলায় দুটি পৃথক প্রকল্প হাতে নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্রকল্প ছিল ৮৫০ কোটি টাকার। সেসব প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়েছে। এসব ঘটনায় স্বাস্থ্য খাতে নেতৃত্বের ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
নেতৃত্ব-সংকট
৫ সেপ্টেম্বর করোনা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে একটি অনলাইন সেমিনারে মূল উপস্থাপনায় বলা হয়, করোনা মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা নেতৃত্বে নেই। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল বিশৃঙ্খল। বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন এই সেমিনারের আয়োজন করেছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মহামারির সময় কাজগুলো হয়েছে আমলানির্ভর নেতৃত্ব থেকে, যে নেতৃত্বের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বিশেষ কোনো ধারণা বা জ্ঞান নেই বা ছিল না।
অন্যদিকে একাধিক ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ বা মতভিন্নতা দেখা দেয়। জেকেজি ও রিজেন্ট কীভাবে অনুমতি পেল, নিয়ন্ত্রণকক্ষ কে নিয়ন্ত্রণ করবে—এ রকম ঘটনাগুলোতে কর্মকর্তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এসব বিরোধের কারণে করোনা মোকাবিলার কিছু কিছু কাজ বন্ধ থাকে। অনেকে মনে করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সঠিক নেতৃত্বের হাতে থাকলে এসব ঘটতে পারত না।
মহামারির সময় কাজগুলো হয়েছে আমলানির্ভর নেতৃত্ব থেকে, যে নেতৃত্বের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বিশেষ কোনো ধারণা বা জ্ঞান নেই বা ছিল না।মুজাহেরুল হক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা
করোনাকালে নানা সমস্যা, দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগ ওঠার পর প্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। প্রথমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এরপর অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকেও বদলি করা হয়। একপর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান ও পরিচালক (উন্নয়ন) ইকবাল কবিরকে ওএসডি করা হয়। একপর্যায়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেন।
মহামারির জরুরি সময়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদের পরিবর্তন মহামারির কাজকেই বাধাগ্রস্ত করেছিল বলে অনেকেই মনে করেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের কিছু মন্তব্য মহামারিকে গুরুত্বহীন ভাবার পেছনে কাজ করেছে। ২১ মার্চ ধানমন্ডির এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী।’ ৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনোভাবে করোনাভাইরাস চলে এলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা আগে থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আছি।’
অবহেলায় মোকাবিলার কাজ
এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নীতিনির্ধারকদের এই ধরনের বক্তব্যে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না, এতে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা উদ্যম হারিয়েছেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা, করোনা পরীক্ষা করা, শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের চিহ্নিত করা (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করা, আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) করা—এই প্রাথমিক কাজগুলো শুরু থেকে বাংলাদেশ ঠিকমতো করেনি। এখনো কাজগুলো হচ্ছে না।
মহামারি মোকাবিলায় বা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কী কী কাজ চলমান আছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, আগের সব কাজ চলমান আছে। তিনি বলেন, খুব শিগগির করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ নতুনভাবে শুরু করা হবে। থেমে থাকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিও চালু করা হচ্ছে। করোনার টিকা আনার জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরির করা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি শেষ হয়ে যায়নি, মহামারি মোকাবিলার সময়ও শেষ হয়নি। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়ে মানুষকে সচেতন রাখার কাজ জারি রাখতে হবে। ঠিকভাবে কাজটি করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। টিকা সংগ্রহের ব্যাপারেও সরকারকে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।