দেশের এক কোটি মানুষকে আজ শনিবার করোনাভাইরাসের প্রথম ডোজ টিকা দিতে চায় সরকার। টিকা পেতে কোনো ধরনের নিবন্ধন কিংবা কাগজপত্র লাগবে না। জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, এমন ব্যক্তিরাও আজ নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে টিকা নিতে পারবেন।
সারা দেশে ২৮ হাজার বুথে টিকা দেওয়া হবে আজ। এসব বুথে টিকা দেওয়ার কাজে যুক্ত থাকবেন স্থাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকেরাসহ মোট ১ লাখ ৪২ হাজার জন। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে নির্ধারিত টিকাকেন্দ্রের বাইরেও পাঁচটি করে ভ্রাম্যমাণ দল (তাঁরাও টিকা দেবেন) থাকবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে ৩০ থেকে ৫০টি করে বুথে টিকা দেওয়া হবে। লোকজনকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে গত কয়েক দিন মাইকিং, গণবিজ্ঞপ্তিসহ বিশেষ প্রচার চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দেশে করোনার গণটিকাদান শুরু হয় গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। এরপর থেকে গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত করোনার প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন ১০ কোটি ৮ লাখের বেশি মানুষ। আর এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছেন ৮ কোটি ১৭ লাখের বেশি মানুষ।
এদিকে আজ যাতে বিভিন্ন কেন্দ্রে টিকাগ্রহীতাদের ভিড় কিছুটা কম হয়, সে জন্য গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেও সারা দেশের সব টিকাদানকেন্দ্র খোলা ছিল। এসব কেন্দ্রে গতকাল সকাল থেকেই টিকাগ্রহীতাদের ভিড় দেখা যায়। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশিদ আলম সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিশেষ টিকা ক্যাম্পেইন হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি (আজ)।
এরপর প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ থাকবে। ওই ঘোষণার পর দেশের টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে ভিড় বাড়তে থাকে। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ২৬ ফেব্রুয়ারির পরও প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ হবে না। তবে প্রথম ডোজের চেয়ে দ্বিতীয় ও বুস্টার (তৃতীয়) ডোজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
টিকাদানকেন্দ্রে ভিড়
গতকাল শুক্রবার করোনার টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি নিবন্ধন করেননি এমন ব্যক্তিরাও টিকা পেয়েছেন। তবে জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, এমন ব্যক্তিদের টিকা পেতে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ১৮ বছরের কম বয়সীরাও টিকা নিতে এসেছিলেন। নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের মেসেজ (মুঠোফোনে খুদে বার্তা) ছাড়াই টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে যাঁরা আগে অন্য কেন্দ্রে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন, তাঁদের নির্ধারিত কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করেন স্থাস্থ্যকর্মীরা।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. সালাউদ্দিন টিকা দিতে আসেন শিশু হাসপাতাল কেন্দ্রে। তাঁর জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র কোনোটাই নেই। শিশু হাসপাতালের বুথের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তাঁকে বলেন, টিকা পেতে অন্তত জন্মনিবন্ধন থাকা লাগবে। সালাউদ্দিন বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, শুধু মুঠোফোন নম্বর থাকলেই টিকা পাওয়ার কথা। তাঁদের কথোপকথনের সময় এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শিশু হাসপাতালের টিকা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। তাঁরা বলেন, অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অন্য কেন্দ্রে নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু পরিচয়পত্র ছাড়া টিকা দেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় তাঁরা এখানে চলে আসছেন। তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে অন্তত জন্মনিবন্ধনের কথা বলা হয়েছে। পরে সালাউদ্দিনকে মুঠোফোন নম্বরের মাধ্যমে একটি টিকা কার্ড দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যসচিব শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জন্মনিবন্ধন বা পরিচয়পত্র না থাকলেও টিকা দিতে হবে। এ বিষয়ে টিকাকেন্দ্রগুলোতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দু–একটি কেন্দ্র নির্দেশনা না মেনে নিজেদের মতো কাজ করছে। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রেই এ ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের চারতলায় টিকাদানকেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যাঁরা নিবন্ধন করে এসেছেন, তাঁদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য এক পাশে ব্যবস্থা, আর যাঁরা নিবন্ধিত নন, তাঁদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন রয়েছে, কিন্তু নিবন্ধন করেননি তাঁরা সহজেই টিকা পাচ্ছেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের টিকাদানকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সিং ম্যানেজার মঞ্জু আরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা আসছেন, সবাইকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন বা পরিচয়পত্র না থাকলে মুঠোফোন নম্বরের বিপরীতে টিকা কার্ড করে দেওয়া হচ্ছে। এ কার্ডই টিকার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
শনাক্তের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে
দেশে করোনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত সাত সপ্তাহের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন শনাক্তের হার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৫ হাজার ৬৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্ত হয় ১ হাজার ৪০৬ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমিত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে করোনা পরিস্থিতি প্রায় সাড়ে তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রনের দাপটে রোগী শনাক্তের সংখ্যা ও হার দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৭ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল। এরপর নিয়মিত রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার কমছে।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্তের ঘোষণা দেয় সরকার। সংক্রমণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮২ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ১৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৬ হাজার ৯৩৬ জন।