করোনা মহামারি
টিকার নিবন্ধন নিজ উদ্যোগে
জেলায় জেলায় অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা মানুষের চেয়ে করোনার টিকা বেশি। নিবন্ধনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
৬ দিনে ৩০ হাজার ৮০০ মানুষের নিবন্ধন।
কোনো জেলায় তালিকাভুক্তি বেশি, কোনো জেলায় একেবারেই কম।
করোনার টিকার নিবন্ধন সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের নতুন এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা পেতে প্রত্যেককে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরের মাধ্যমে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে, তাঁদেরও নিবন্ধন নিতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিক নিবন্ধন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার প্রয়োজন নেই। এর কম বয়সীদের মধ্যে যাঁরা অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছেন, কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করতে পারছেন না, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ই-মেইল করে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর পাঠাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এমন সাত দফা নির্দেশনাসহ এক চিঠি গত ৩১ জানুয়ারি সারা দেশে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জেলায় জেলায় পাঠানো টিকার সংখ্যা ও অগ্রাধিকার পাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যায় বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। মাঠ কর্মকর্তারা বুঝে উঠতে পারছেন না পর্যাপ্ত নিবন্ধন না হলে তাঁরা টিকা কীভাবে ব্যবহার করবেন। টিকা নেওয়ার জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন শুরু হয়েছে ২৭ জানুয়ারি। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ৬ দিনে ৩০ হাজার ৮০০ মানুষ নিবন্ধন করেছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
ওয়েবসাইটের বাইরে অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন বৃহস্পতিবার শুরু হতে পারে বলে গত রোববার এক অনুষ্ঠানে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে আসা সব টিকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা দরকার। নইলে খারাপ উদাহরণ তৈরি হবে, ভবিষ্যতে টিকা আসার ক্ষেত্রে তা বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার টিকার নিবন্ধন বিষয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। সুরক্ষা অনলাইনে ঢুকে আমি নিজেই নিবন্ধন করতে পারিনি। বহু মানুষ নিবন্ধন করতে পারবেন না বলে আমি ধারণা করছি।’ তিনি বলেন, টিকাকেন্দ্রে গিয়ে নিবন্ধন করা যাবে বলে বলা হচ্ছে। এতে টিকাকেন্দ্রে ভিড় ও মানুষের বিরক্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এই জনস্বাস্থ্যবিদ আরও বলেন, টিকার নিবন্ধন ও টিকাকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরও মনোযোগী হওয়া দরকার।
জেলার পরিস্থিতি
গোপালগঞ্জ জেলায় ৩৬ হাজার ডোজ টিকা গেছে। প্রথম ডোজ হিসেবে এই টিকা ৩৬ হাজার মানুষকে দেওয়া যাবে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এই জেলায় চার হাজার মানুষের নাম তালিকাভুক্ত করতে পেরেছে জেলা প্রশাসন।
জেলার করোনাবিষয়ক কমিটি এ নিয়ে গতকাল সভা করেছে। গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জনসাধারণকে নিবন্ধন করার জন্য আহ্বান জানাব। প্রতিটি মসজিদের মাইক থেকে এ ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় মাইকে ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
পাশের জেলা ফরিদপুরে করোনার টিকা গেছে ৬০ হাজার ডোজ। তবে জেলাটিতে এ পর্যন্ত শুধু আড়াই হাজার মানুষের তালিকা তৈরি করতে পেরেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপক কুমার রায় প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমরা তালিকা পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করছি।’ তবে তিনি বলেন, ৭ ফেব্রুয়ারি টিকা কার্যক্রম শুরুর আগে হয়তো ২০ হাজার মানুষের নিবন্ধন করা সম্ভব হবে।
১৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি থেকে জেলায় জেলায় করোনার টিকার অগ্রাধিকার পাওয়া জনগোষ্ঠীর তালিকা করতে বলা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত কোনো কোনো জেলায় নিবন্ধন হয়েছে বেশি, কোনো কোনো জেলায় অনেক কম।
যেমন ময়মনসিংহ জেলায় ১ লাখ ৮ হাজার মানুষের তালিকা তৈরি হয়েছে। যদিও পাশের জেলা নেত্রকোনায় তালিকা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার মানুষের। উত্তরের জেলা নওগাঁয় সাড়ে ৪৯ হাজার মানুষের তালিকা হয়েছে। খুলনায় তালিকা হয়েছে ৯৭ হাজার ২৩০ জনের। অথচ নড়াইল জেলায় তালিকায় এসেছেন মাত্র ২ হাজার ২০ জন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই পার্থক্যের কারণ সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকা।
৭ দফা নির্দেশনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের লাইন ডিরেক্টর মো. মিজানুর রহমান দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে করোনার টিকা নিবন্ধন সহজ করার নির্দেশনা দেন। একাধিক সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ৩১ জানুয়ারি লেখা চিঠি তাঁরা গতকাল পেয়েছেন।
এ বিষয়ে করোনাবিষয়ক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র মোহাম্মদ রোবেদ আমিন প্রথম আলোকে বলেন, আশা করা হচ্ছে, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়বে।
১. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ টিকাপ্রাপ্তির জন্য প্রত্যেককে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরের মাধ্যমে www.surokkha.gov.bd ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে।
২. ৫৫ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিক নিবন্ধন করতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকার প্রয়োজন নেই।
৩. ৫৫ বছরের কম বয়সী যাঁরা অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দ্বারা নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বা নিবন্ধন সম্ভব হচ্ছে না, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে [email protected] মেইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরের তালিকা পাঠাতে হবে।
৪. প্রতিটি টিকাকেন্দ্রে একটি ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি নিবন্ধন বুথ প্রস্তুত রাখতে হবে।
৫. স্বাস্থ্য সহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ট্যাবের সাহায্যে নিবন্ধনকাজে সহায়তা করবেন।
৬. কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপিরা (কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার) ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগসুবিধার মাধ্যমে নিবন্ধনের ব্যাপারে সহায়তা করবেন।
৭. নিবন্ধনকাজে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহায়তা দরকার।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর)