টিকার ট্রায়ালে সুরক্ষার কী ব্যবস্থা, বাংলাদেশ কী করছে?
তিন দিন স্থগিত থাকার পর যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনার টিকার ট্রায়াল গত শনিবার থেকে আবার শুরু হয়েছে। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ ধরনের বিশাল ট্রায়ালে এমন ঘটনা বিরল কিছু না।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও টিকা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তদন্ত করতে ট্রায়াল থামানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই ধারাবাহিকতায় অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়ালও কিছু বিরতির পর পুনরায় শুরু হয়েছে। টিকার ট্রায়াল কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখার ঘটনা টিকার নিরাপত্তা যাচাইয়ে যে কঠোর নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে, তার একটি সফল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশেও করোনার চীনের তৈরি টিকা সিনোভ্যাকের তৈরি ট্রায়াল শুরু হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ামাত্র যাতে তা শনাক্ত করা যায়, সে জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ৯ সেপ্টেম্বরের তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী এখন করোনার ১৮০টি টিকা তৈরির উদ্যোগ চালু আছে। এর মধ্যে ৩৫টি টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। আর এর মধ্যে নয়টি টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে। অক্সফোর্ডের টিকা টিও তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে। অক্সফোর্ডের এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে খ্যাতনামা ওষুধ কোম্পানি অ্যাসট্রোজেনেকা। দুই প্রতিষ্ঠান গত বুধবার জানায়, টিকা গ্রহণকারী এক স্বেচ্ছাসেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ট্রায়াল স্থগিত করা হয়েছে। এই ব্যক্তির অসুস্থতার কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানায়নি প্রতিষ্ঠান দুটি। তবে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, অসুস্থ ব্যক্তির ট্রান্সভার্স মাইলিটিস হয়েছিল। এতে স্পাইনাল কর্ডে (স্নায়ু রজ্জু) ব্যথা হয়। এরপর গত শনিবার প্রতিষ্ঠান দুটি জানায়, যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তাদের আবার ট্রায়াল চালুর অনুমতি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও খ্যাতনামা টিকা বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী কাদরী প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পণ্যের মধ্যে টিকা বা ভ্যাকসিন ব্যাপকভাবে পরীক্ষিত হয়ে থাকে। গবেষকদের জন্য টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। গবেষকেরা সব সময় নিশ্চিত হতে চান যে টিকার ট্রায়ালে অংশ নেওয়া অংশগ্রহণকারীদের যেন কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। আর এ কারণেই নিরাপত্তা পর্যালোচনা শেষ হয়ে গেলে অনেক ট্রায়াল পুনরায় চালু হয় এবং কোনো ঘটনা ছাড়াই গবেষকেরা সফলভাবে ট্রায়াল শেষ করতে পারেন।
গবেষকেরা বলছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় ‘বিশ্বাস ও আস্থা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বাস ও আস্থা সংকট নিরসনের প্রচেষ্টায় অগ্রগতি আনতে সহায়তা করবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে গবেষকেরা তাঁদের জ্ঞাতসারে অপ্রয়োজনীয় ও অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকির সম্মুখীন করবেন না। এর পাশাপাশি সবাইকে আস্থা রাখতে হবে যে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে উত্তীর্ণ যেকোনো ওষুধ বা টিকা নিরাপদ এবং কার্যকর। এই উভয় বিষয়ের জন্য একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বলবৎ থাকে, যা এই মুহূর্তে অত্যন্ত ভালোভাবে কাজ করছে।
অ্যাসট্রোজেনেকার প্রতিনিধি আজ রোববার গার্ডিয়ানকে বলেছেন, একটি স্বাধীন কমিটি যুক্তরাজ্যের টিকার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরিকে (এমএইচআরএ) টিকা চালিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। এখন আর কোনো বাধা নেই।
তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উদ্দেশ্য হলো টিকার কার্যকারিতা এবং সুরক্ষার মূল্যায়ন করা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যবেক্ষণ করা। যেমন বয়স এবং লিঙ্গের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে টিকার কার্যকারিতার সম্পর্ক কোনো আছে কি না, তা দেখা। এ কারণে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের জন্য বেশিসংখ্যক অংশগ্রহণকারী এবং দীর্ঘ সময়ের গবেষণার প্রয়োজন হয়। একটি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের মাধ্যমে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অনেক লোককে দেওয়া টিকাটি সত্যিই কার্যকর কি না, তা গবেষকেরা জানতে পারেন। এই ফলাফলগুলো পরে টিকার অনুমোদনের/লাইসেন্সের ক্ষেত্রে প্রয়োজন।
অক্সফোর্ডের এ টিকা ইতিমধ্যে ১৪ হাজার মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে।
আমাদের গবেষণার প্রটোকল তৈরিতে আমরা অনেক সময়, প্রচেষ্টা এবং চিন্তাভাবনা ব্যয় করেছি। যাতে কোনো সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ামাত্র আমরা তা শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমরা অংশগ্রহণকারীদের সাপ্তাহিক ফলোআপ ছাড়াও চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত সার্বক্ষণিক সেবায় একটি ২৪/৭ কল সেন্টারের ব্যবস্থা রেখেছি। নিঃসন্দেহে অংশগ্রহণকারীদের সুরক্ষা আমাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।কে জামান, আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন মনে করেন, অক্সফোর্ডের টিকার এ ট্রায়াল স্থগিত করে স্বচ্ছতার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এতে ভবিষ্যৎ সমস্যার ক্ষেত্রে আরও সাবধান হওয়া যাবে। আর অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ট্রায়াল চালাচ্ছে তাদের জন্যও এটা একটা শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে।
অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়াল বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই ঘটনায় করোনার টিকা পেতে বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব কী? এ নিয়ে কথা হয় দেশের একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তাঁদের অভিমত, ট্রায়ালের বিরতি নিয়ে অতিমাত্রায় জল্পনাকল্পনার একটি প্রতিকূল দিক হতে পারে যে যখন পরবর্তী সময়ে কোনো টিকা পাওয়া যাবে তখন হয়তো কম মানুষই সার্স-কোভি-২–এর বিরুদ্ধে টিকা নিতে আগ্রহী হবে। যদি পর্যালোচনায় এটি নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়, তারপরও এমনটা ঘটার আশঙ্কা আছে।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী কে জামান বলেন, ‘অনেকগুলো পরীক্ষামূলক কোভিড-১৯ টিকার মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কেবল একটি সম্ভাব্য টিকা। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় কেবল একটি বিরূপ ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, সুতরাং আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে এবং বিরূপ ঘটনার পর্যালোচনা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে দিতে হবে। আগেই কোনো ধরনের উপসংহারে পৌঁছানো উচিত নয়। সব পরীক্ষামূলক টিকার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।’
একটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি রয়েছে: এফডিএ গুড ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস (বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয় নির্দেশাবলি) নির্দেশিকা অনুসরণ করে বিপুলসংখ্যক অংশগ্রহণকারীদের তালিকাভুক্তি, সুরক্ষা প্রোটোকলগুলো কার্যকর রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা এবং দক্ষ এবং নিবেদিত কর্মীদের নিযুক্ত করা। এসব কিছু একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। নিবিড়ভাবে এসবের অনুসরণ সম্ভাব্য সব সমস্যা দূর করতে সহায়ক হয়।
অক্সফোর্ডের মতোই তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে চীনের সিনোভ্যাকের টিকা। এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে। সরকার এর অনুমোদন দিয়েছে। ট্রায়াল পরিচালনা করবে আইসিডিডিআরবি। এখন সেই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিষয়ে কী ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে কে জামান বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় আমরা যে টিকাটি ব্যবহার করব, তা একটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভাইরাসনির্ভর টিকা, পদ্ধতিটি দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এবং বহুল ব্যবহৃত। এই পদ্ধতিটি নিরাপদ বা খুব কম ঝুঁকির বলেই মনে করা হয়। আমাদের গবেষণায় ব্যবহৃত টিকাটি ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আওতায় হাজার হাজার মানুষ গ্রহণ করেছে এবং অনেক চীনা নাগরিককে জরুরি ব্যবহারের অধীনে ইতিমধ্যে এই টিকা দেওয়া হয়েছে।’
জামানের বক্তব্য, এখন পর্যন্ত এ টিকার কোনো গুরুতর বিরূপ প্রভাব দেখা যায়নি।
কে জামান বলেন, ‘আমাদের গবেষণার প্রটোকল তৈরিতে আমরা অনেক সময়, প্রচেষ্টা এবং চিন্তাভাবনা ব্যয় করেছি। যাতে কোনো সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ামাত্র আমরা তা শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমরা অংশগ্রহণকারীদের সাপ্তাহিক ফলোআপ ছাড়াও চিকিৎসক দ্বারা পরিচালিত সার্বক্ষণিক সেবায় একটি ২৪/৭ কল সেন্টারের ব্যবস্থা রেখেছি। নিঃসন্দেহে অংশগ্রহণকারীদের সুরক্ষা আমাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।’
টিকার প্রাপ্যতা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোভিড-১৯ টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কোভেক্স ফ্যাসিলিটিতে (কোভিডের টিকা স্বল্পমূল্যে দিতে গ্যাভি অ্যালায়েন্স ও ডব্লিউএইচওর মিলিত উদ্যোগ) যোগদান, সম্ভাব্য পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কোটি-১৯ টিকা বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ।
ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিকা পাওয়ার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমরা আশাবাদী যে কোনো কোভিড-১৯ টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিকোয়ালিফিকেশন পেলে এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হলে বাংলাদেশ টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে থাকবে।’