বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলতে থাকা অবস্থায় অধিকাংশ দেশ লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জনগণের প্রতি জানিয়ে আসছে। গত প্রায় এক মাস ধরে বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা দ্বিতীয় এই তাণ্ডবের মুখে এটা এখন ক্রমশই পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে করোনার জীবাণু ধনী আর দরিদ্রের পার্থক্য বিবেচনা না করে আঘাত হানলেও দ্বিতীয় এই অদৃশ্য আঘাত আসছে মূলত গরিবের ওপর। ধনী দেশগুলো এই আঘাত সামলে নেওয়ার লক্ষ্যে নানারকম প্রণোদনা পদক্ষেপ গ্রহণ করে চললেও দরিদ্রের সামনে সেই পথে অগ্রসর হওয়ার মতো সামর্থ্য খুবই সীমিত। ফলে দরিদ্র এখন করোনার আঘাত থেকে রক্ষা পেলেও পেটে-ভাতে মারা যাওয়ার অবস্থা তার। এটা যেমন প্রতিটি দেশের নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে হয়ে উঠছে দৃশ্যমান, একই সঙ্গে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও এই অসমতা নিয়ে আসছে অশনি সংকেত।
বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় তিন মাস থমকে থাকার সুদূরপ্রসারী পরিণতি কী হতে পারে, সেই হিসাব অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে হয় এখনো সঠিকভাবে করে উঠতে পারেননি। তবে ধনীর অবস্থা যেন সংকটাপন্ন হয়ে না ওঠে, সে জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে হুংকার এখন থেকেই উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। সেই হুংকারের পেছনে আছে খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় এদের নেওয়া পদক্ষেপ যেন কোনো অবস্থাতেই বিপদাপন্ন না হয় তা নিশ্চিত করে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা। এ রকম বার্তাই বিশ্ব পেয়েছে ধনী রাষ্ট্রসমূহের জোট জি-২০ এর কৃষি মন্ত্রীদের সদ্য শেষ হওয়া এক ভিডিও সম্মেলনে।
কিছু কিছু দেশ দৃশ্যত উদ্বিগ্ন যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশ লকডাউন ও অন্যান্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, খামার পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি তা করতে পারে এবং এর থেকে বিভিন্ন দেশ হয়তো নিজস্ব বাজারে ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে কৃষিপণ্যের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। আসলে কিন্তু কিছু কিছু দেশ ইতিমধ্যে সেই পথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। রাশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াসহ ১০টির বেশি দেশ খামার পণ্য, বিশেষ করে শস্য রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ফলে ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে খাদ্য সামগ্রীর বড় এক অংশ যাদের বাইরে থেকে আমদানি করে আনতে হয়, তারা এখন মহা দুশ্চিন্তায় সময় কাটাতে শুরু করেছে। জি-২০ কৃষি মন্ত্রীদের ভিডিও সম্মেলন এদের উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলন শেষে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারি চলা অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তার ওপর হুমকি হয়ে দেখা দেওয়া এবং খাদ্য সরবরাহের বৈশ্বিক চক্রকে বিঘ্নিত করা যে কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা এরা করছে। 'অন্যায় নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ' হিসেবে আখ্যায়িত করা সেরকম পদক্ষেপ, যা কিনা আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি করে দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে, সেরকম যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার বিবৃতিতে ব্যক্ত করা হয়। এদের সেই অবস্থান অবশ্য যে একই সঙ্গে দরিদ্রকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেও গ্রহণ করা, সেরকম ধারণা দেওয়ার জন্য গরিবের দোহাই দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে বিশ্ব জনসংখ্যার বড় এক অংশের জন্য পুষ্টির উৎসকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া সেই পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিয়ে জাপানের কৃষিমন্ত্রী তাকু এতো ভিডিও সম্মেলন চলাকালে বলেছেন, করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে আমদানি-রপ্তানির ওপর অপ্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা কোনো দেশেরই উচিত হবে না। জাপানের মন্ত্রীর ভবিষ্যতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া এবং সতর্কতা উচ্চারণ করার যথেষ্ট কারণ আছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিক থেকে জাপানের অবস্থা যথেষ্ট নাজুক। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে চাল ছাড়া দৈনন্দিন চাহিদার ভোগ্যপণ্যের বড় এক অংশের জন্য বিদেশের বাজারের ওপর জাপানকে নির্ভর করতে হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে এই নির্ভরতা হচ্ছে অনেকটা যেন চূড়ান্ত। যেমন, জাপানে প্রয়োজন হওয়া গমের ৮৮ শতাংশ এবং সয়াবিনের ৯২ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে। ফলে করোনা পরবর্তী সময়ে কৃষি ও শিল্প পণ্যের উৎপাদন আবারও প্রায় শূন্য থেকে শুরু করতে হলে সেরকম অবস্থায় খাদ্য সরবরাহের চালান যেন বন্ধ হয়ে না যায়, জাপানসহ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া আরও অনেক ধনী দেশ এখন থেকেই তা নিশ্চিত করে নিতে চাইছে।
বিশ্ববাজারের এ রকম সম্ভাব্য ভারসাম্যহীন অবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ভেতরেও এখন করোনাভাইরাস ধনী-দরিদ্রের ফারাক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর বড় এক অংশকে লকডাউনের কারণে ঘরে বসে থাকতে হওয়ায় এদের নিয়মিত আয়ের পথও ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। একই অবস্থা খুচরা পণ্য বিক্রি খাতেরও। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই দোকানপাট বন্ধ থাকায় সেই সব দোকানে বিক্রির জন্য আসা পণ্যের চালান এখন থমকে দাঁড়িয়ে। ফলে কাজ হারাচ্ছেন সেরকম পণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত পিছিয়ে পড়া দেশের শ্রমিক শ্রেণি। আঘাতটা আবারও তাই বেশি করে আসছে গরিবের ওপর। রাষ্ট্রের সেখানে কী করণীয় আছে তা মনে হয় আরও গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। কেবল বস্তা-ভর্তি চাল বিতরণেই সমাধান নেই। প্রয়োজন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং এমন এক ব্যবস্থা গড়ে নেওয়া রাষ্ট্র যেখানে সত্যিকার অর্থে কল্যাণমুখী হয়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতে আরও একটি আঘাত এলে তা সামলে ওঠার মতো ক্ষমতা অর্জন করবে।