কোভিড: কর্মহীন মানুষের সংখ্যাই বাড়ছে
প্রতিটি মুহূর্ত যেন করোনার আতঙ্ক তাড়া করছে। একেকটি দিন পার করার মানে হচ্ছে করোনামুক্ত চ্যালেঞ্জ। গোটা বিশ্বে শুধু আক্রান্ত আর মৃত্যুর হারই বাড়ছে না, মানুষের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকায় অনেক বড় হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ববাজার। বাড়ছে অর্থসংকট। ইতিমধ্যেই ভাটা পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। তবে এই মন্দা স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে, তা-ও বলতে পারছেন না অর্থনীতিবিদেরা। দিন দিন দেশজুড়ে ক্ষুধার্ত ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যাই শুধু বাড়ছে।
বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। চাকরি হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, করোনার প্রভাবে পৃথিবীতে কয়েক কোটি মানুষ চাকরি হারাবে।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে বেকারত্বের হার। পৃথিবীতে সব দেশে একযোগে চলছে ছাঁটাই, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতি। করোনাভাইরাস শুধু জীবন ও স্বাস্থ্যেই প্রভাব ফেলছে না, এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে সব ধরনের অর্থনীতিতেও। যার ফলে ব্যবসা–বাণিজ্য নিম্নমুখী হওয়াতে কর্মীরা চাকরি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে পাইলট থেকে শুরু করে নিম্নশ্রেণির পেশাজীবী মানুষকে।
মাত্র একজনের চাকরির অর্থ উপার্জন দিয়ে গোটা পরিবার চলে—এমন পরিবারের সংখ্যা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি। সেই চাকরির কিছু হলে যে অন্য কিছুর হাল ধরবে, তারও কোনো পরিস্থিতি বর্তমানে নেই। করোনা সংকটের কারণে করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। পরিবার চালাতে বিপাকে পড়ছেন মধ্যবিত্তরা।
দেশে চাকরি না পাওয়ায় বিদেশে এসে কাজ করা প্রবাসীরা আছেন সবচেয়ে বিপদে। ইতিমধ্যে কয়েক লাখ প্রবসী চাকরি হারিয়েছেন এই করোনার কারণে। তবে সুদিনে যাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল ছিল, তাঁদের এই বিপদের সময় দেশ তাঁদের জন্য কী করতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। তাই ওই দেশগুলোর লকডাউনের প্রভাব সার্বিকভাবে জিডিপিতেও পড়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশে এই রেমিট্যান্সের হার ২২ শতাংশ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।
জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের আট দেশেই বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রবাসীরা থাকেন। এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে। গালফের কিছু দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইরাক, লেবানন—এসব দেশ থেকেই চাকরি হারিয়ে কর্মীরা ফিরে আসছেন।
করোনার ফলে ভোগ, সরকারি ব্যয়, আমদানি ও রপ্তানি সূচক দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। আর করোনাভাইরাস বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতির কতটা ক্ষতি করেছে, তার প্রমাণ হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ এক অর্থবছরেই জিডিপির ২৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ হয়ে গেছে।
কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদনে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং সেবা খাতের কার্যক্রমও বন্ধ।
করোনা দুর্যোগে চাকরি হারিয়ে দিশেহারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা। আর তাই বাজেটে করোনায় কর্মহীন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মহীন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এবারের বাজেটে কর্মহীন প্রবাসীদের দেশে পুনর্বাসন ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। শুধু তা–ই নয়, রেমিট্যান্স নিয়ে শঙ্কা থাকলেও করণীয় নিয়ে পরিষ্কার নির্দেশনাও ছিল না এবারের বাজেটে।
২ শতাংশ প্রণোদনা বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করলে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা করেন শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা। ১ কোটি প্রবাসীর পাঠানো দেড় হাজার কোটি ডলারের ওপর ভর করে শক্ত ভিত পেয়েছে দেশের অর্থনীতি। তবে সে ভিতকে ঝাঁকুনি দিয়েছে করোনা মহামারি। গেল এপ্রিল ও মে—এই দুই মাসে গত বছরের তুলনায় কম রেমিট্যান্স এসেছে। তাই চিন্তার ভাঁজ খোদ অর্থমন্ত্রীর কপালেও। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও উঠে আসে আগামী দিনে রেমিট্যান্স আরও কমার আশঙ্কা।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় আঘাত আসা শুরু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী—এই দুই ধরনের অর্থনীতিতেই স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এই স্থবিরতার প্রভাব অচিরেই গিয়ে পড়বে চাকরির বাজারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস কারণে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাঁদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছেন।
যার মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ বসবাস করেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশেও বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী কর্মচ্যুত হবেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারেন অন্তত দেড় কোটি মানুষ।
তবে সাধুবাদ জানাতে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, পরিস্থিতির আলোকে দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যানচালক, মোটরশ্রমিক ও নির্মাণশ্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেলশ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ যাঁরা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের কারণে কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের জন্য কিছু সহায়তা বরাদ্দ করেছেন।
দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে এশিয়ায় চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চরম আঘাত হানায় কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এই চাপে বেকারত্ব বেড়েছে কোরিয়ার মাটিতেও। দেশটিতে ১০ বছরের মধ্যে বেকারত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এপ্রিলে সেখানে বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৮ ভাগ। তা মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪ দশমিক ৫ ভাগে। ১০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে বেকারত্বের হার এত বৃদ্ধি পায়নি দেশটিতে। তাই ৩০ জুনের মধ্যে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ‘আনডকুমেন্টেড’ ব্যক্তিদের কোরিয়া ত্যাগ করার জন্য নিদের্শ দিয়েছে এ দেশের সরকার। স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে না গেলে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে তাঁদের।
প্রাণঘাতী ভাইরাসটির কারণে লন্ডভন্ড করে দেওয়া অর্থনীতি ফিরবে তো আগের অবস্থায়? কর্মহীন বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে তো? স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিতে কোনো উন্নতি হবে কি? আবার আগের মতো আতঙ্কহীন জীবন-জীবিকা ফিরে পাব কি? আবার কবে বিশ্বমন্দা দ্রুত কেটে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বাড়বে? এমন আনেক প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
আবার এমন সময় কবে আসবে, প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ থাকবে, বাড়বে চাহিদা, কেউ চাকরি হারাবেন না, কারও বেতনও কমবে না। তবে মাত্র একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থাকলেও পৃথিবী অনিরাপদ। আবার নিরাপদ পৃথিবীতে স্বপ্ন গড়ার প্রত্যয় কোটি মানুষের হৃদয়ে।