করোনায় শিশুদের নতুন জটিলতা এমআইএস-সি
১১ বছরের রাফি আবরার চৌধুরী ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর নিয়ে গত ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। হাসপাতালের রেজিস্ট্রি খাতায় তার নাম আয়ান। এর আগে ২৪ জুলাই তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তিন দিন ধরে নানান নমুনা একাধিকবার পরীক্ষা করে ১৭ আগস্ট চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন, আয়ান কোভিড–১৯ রোগের জটিল ও বিরল অসুস্থতা মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেনে (এমআইএস–সি) আক্রান্ত।
এই হাসপাতালে এমআইএস–সি শনাক্ত মোট ১৭টি শিশুর মধ্যে শুধু আয়ানকে সুস্থ করতে দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসা দিতে হয়েছিল। কোভিড–১৯ আক্রান্ত বা আক্রান্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিল এমন শিশু–কিশোরদের মধ্যে এমআইএস–সি দেখা যাচ্ছে। এপ্রিল মাসে এটি প্রথমে যুক্তরাজ্য ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকেরা শনাক্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সম্প্রতি এ নতুন অসুস্থতার সঙ্গে করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। ২১ বছরের কম বয়সীরা এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এটাকে পেডিয়াট্রিক ইনফ্লেমটরি মাল্টিসিস্টেম সিনড্রোমও (পিআইএমএস) বলা হয়। কোভিডের সাধারণ উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বা কাশি নেই, এমন শিশুদের মধ্যেও এ জটিলতা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সিডিসি।
আয়ানের বাবা মেহেদী হায়দার চৌধুরী একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আয়ান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। গত ১৯ জুলাই তার প্রথম জ্বর আসে, এর তিন দিন আগে জ্বর আসে বাবার। নমুনা পরীক্ষায় দুজনেরই করোনা শনাক্ত হয়। কদিন পর তার মা নাজনীন সুলতানাও করোনায় আক্রান্ত হন।
মেহেদী হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, আয়ানের দ্বিতীয় দফার অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ হওয়ার আগেই জ্বর কমে যায়। কদিন পর আবার জ্বর আসে। টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গুর টেস্ট করালে ফল নেগিটিভ আসে। একদিন জ্বর ১০৬ ডিগ্রিতে উঠে যায়। সেই সঙ্গে শুরু হয় কাশি। তখন রাত সাড়ে ১০টায় তিনি ছেলেকে নিয়ে যান এভারকেয়ার হাসপাতালে (সাবেক অ্যাপোলো)।
এভারকেয়ার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাদের হাসপাতালে ১৫ মে প্রথম এমআইএস–সি শনাক্ত হয়। মে মাসের শেষ দিকে আরেকটি শিশু শনাক্ত হয়। একজনের বয়স তিন মাস, অপরজনের দুই বছর। এদের প্রচণ্ড জ্বর, ডায়রিয়া, চোখ ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া এবং পায়ে হালকা ফোলা ভাব ছিল। পরে দুই বছরের শিশুটির করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।
বাংলাদেশে প্রথম ওই দুই শিশুর এমআইএস–সি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য সিঙ্গাপুর জার্নাল অব কার্ডিওলজি তাদের সাময়িকীতে তুলে ধরে। এতে জানানো হয়, নিউইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তাদের ৬৪টি শিশুর এমআইএস–সি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত ১৫টি শিশু শনাক্ত হয়। পাঁচ ও সাত বছর বয়সী দুটি ছেলেশিশু ৮ মে মারা যায়।
জনস হপকিন্সের সাময়িকীতে ২২ মে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শিশু–কিশোরদের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের এ সিনড্রোমকে বিরল উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জ্বরের সঙ্গে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়, তার মধ্যে রয়েছে অস্বাভাবিক দুর্বলতা ও অবসাদ, লাল ফুসকুড়ি, পেটে ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া, ঠোঁট লাল হওয়া ও ফেটে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে ওঠা এবং হাত–পা ফুলে যাওয়া। রোগটি এখনো শনাক্তকরণ পর্যায়েই রয়েছে। রোগটি বোঝার জন্য আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে বা সংস্পর্শে আসার চার সপ্তাহের মধ্যে এটি দেখা দিতে পারে।
জনস হপকিন্স চিলড্রেন সেন্টারের শিশুর সংক্রমণ রোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ কেওয়াং সিক কিম শিশুদের মা–বাবার জানার জন্য এমআইএস–সি বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এমআইএস–সি বা পিআইএমএসের কিছু ফিচারের সঙ্গে টক্সিক শক সিনড্রোম (জ্বর, ফুসকুড়ি, বমি, ডায়রিয়া, গাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ) এবং কাওয়াসাকি রোগের অসুস্থতার মিল রয়েছে। এ দুই ধরনের অসুস্থতায় শরীরের রক্তনালিতে প্রদাহ দেখা দেয়। এ প্রদাহ রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যা হৃদ্যন্ত্র, কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এটা চিকিৎসায় ভালো হয়। ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অন্যান্য অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ব্যাপারটি রোধ করতে পারে, বিশেষ করে হৃদ্যন্ত্রের। চিকিৎসক কিমের ভাষায়, শনাক্ত করা সম্ভব হলেই এটা চিকিৎসা করা সম্ভব। প্রদাহ কমানো এবং হৃদ্যন্ত্র, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন, স্টেরয়েডস এবং প্রদাহ রোধ করে এমন ওষুধ প্রয়োগ করতে পারেন চিকিৎসকেরা।
আয়ানের রোগসংক্রান্ত সারসংক্ষেপের কপি ও তার বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমআইএস–সির চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। তার প্রথম ধাপের চিকিৎসা সফল না হওয়ায় দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকেরা।
এভারকেয়ার হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু বিভাগের পরামর্শক এবং আয়ানের চিকিৎসক ফাহ্মিদা জাবীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ হাসপাতালে এমআইএস–সি আক্রান্ত ১৭টি শিশু পেয়েছি। এর মধ্যে আয়ানের বিষয়টি বেশি জটিল ছিল। প্রথম ধাপের চিকিৎসায় সুস্থ না হওয়ায় তাকে দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসা দিতে হয়েছে।’ তিনি জানান, এ রোগে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার জটিলতা দেখা দেয়। আয়ানের ক্ষেত্রে হৃদ্যন্ত্র, অন্ত্র, লিভার, চর্ম ও স্নায়ু জটিলতা দেখা দিয়েছিল। চিকিৎসার পর সব পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো আসার পর যথাযথ ব্যবস্থাপত্র দিয়ে তাকে ২৯ আগস্ট বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, এমআইএস–সি শনাক্ত হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে পাঁচ ও সাত বছর বয়সী দুটি মেয়েশিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১২ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ৩১ আগস্ট বাড়ি ফিরেছে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর। তবে তিন শিশুরই করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল এসেছে।
এই তিন শিশুই চিকিৎসাধীন রয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ক্রিটিকেল কেয়ার নেফ্রোলজি অ্যান্ড ডায়ালাইসিস বিভাগের অধ্যাপক শিরীন আফরোজের অধীনে। শিরীন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের সঙ্গে তিন শিশুর হৃদ্যন্ত্র, কিডনি ও ফুসফুসে গুরুতর জটিলতা দেখা দেয়। এখন একজন সুস্থ হয়েছে। দুজনের চিকিৎসা চলছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহর কাছেও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়েছিল আয়ানের রোগসংক্রান্ত ফাইল। এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এমআইএস–সি একটি বিরল ও জটিল রোগ। দেশে কিছু শিশুর কোভিড–১৯ পরবর্তী এ অসুস্থতা দেখা গেছে। কারও ক্ষেত্রে জটিলতা আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।
এমআইএস–সি রোগের সঙ্গে কোভিড–১৯–এর সম্পর্ক কী জানার চেষ্টা করছেন চিকিৎসকেরা। গবেষকদের এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি রয়েছে। অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন চিকিৎসকেরা। উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বলেছেন তাঁরা।