করোনার দিনগুলোতে
স্টেশনে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা রাতারাতি একেবারে সিকিভাগে নেমে এসেছে। স্টেশনের কার পার্কও ফাঁকা পরে থাকে ইদানীং। আগে যেখানে পার্কিং পেতে খুব ভোরে কাজে যেতে হতো, এখন সেখানে সারা দিনই অনেকগুলো স্পট খালি পড়ে থাকে সারা দিন। আগে যেখানে ট্রেনে উঠে সিট কোথায় পাব, সেটা নিয়ে ভাবতে হতো, এখন সেখানে ট্রেনে উঠে ভাবি, কোনো সিটে বসব। বগির প্রায় পুরোটাই ফাঁকা পড়ে থাকে। এরপরের স্টেশনগুলো থেকে এত বেশি লোক উঠত যে নামার সময় হুড়াহুড়ি লেগে যেত। গেটের কাছে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে মানুষকে নামার জায়গা করে দিত। এরপর স্টেশনের সিঁড়িতে শুরু হতো ছুঁচোর দৌড়। তারপর বাসের সামনে বিশাল লম্বা লাইন। বাসে উঠেও আমরা বেশির ভাগ মানুষই সিট পেতাম না। তবে বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা এবং ছোট বাচ্চাসহ নারীদের সিট করে দিত সবাই নিজেরা দাঁড়িয়ে। তার বিনিময়ে সেই মানুষগুলো এত মিষ্টি করে ধন্যবাদ দেন যে মনটাই ভালো হয়ে যায়। সারাটা দিন খারাপ গেলেও এই একটা ধন্যবাদ আপনার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এটাই সৌজন্য, এটাই ভদ্রতা, এটাই মানবতা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে সবখানেই মানুষের পদচারণ উল্লেখ্যযোগ্যসংখ্যক কমে গেছে।
এবার আসি গত কয়েক দিনের পরিস্থিতি পর্যালোচনায়। করোনার ভয়ে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ শুরুতে সব ধরনের টিস্যু আর স্যানিটাইজার মার্কেট থেকে কিনে ফেলেছে, তার মধ্যে টয়লেট টিস্যু অন্যতম। টয়লেট টিস্যু ফাঁকা করে দেওয়ার পেছনে ঠিক কী কারণ থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তবে আমাদের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে বলল, ‘বাবা, চায়না থেকে খুব শীঘ্রই টিস্যু আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবে তাই সবাই টিস্যু মজুত করছে।’ এ ছাড়া সব ধরনের শুকনো খাবারও শেষ হয়ে যেতে শুরু করল। এ তো গেল অস্ট্রেলিয়ার চেইনশপগুলোর হাল। সম্প্রতি আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তি বাংলা দোকানগুলোতে গিয়েও কোনো ধরনের দ্রব্যসামগ্রী অবশিষ্ট পাননি। উনি ধারণা করে গিয়েছিলেন, দাম বাড়লেও জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। আমাদের এক বাংলাদেশি প্রতিবেশী আমাকে খুদে বার্তা দিলেন যে ওনার বাচ্চার গুঁড়া দুধ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। আমি কোনোভাবে ওনাকে সাহায্য করতে পারি কি না।
ওনার খুদে বার্তা পড়ে চোখের পানি ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না। আমরা কতটা নিচে নেমে গেছি। আমি যত দূর জানি, পশুরাও তাঁদের সমাজে শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়, সে যার শিশুই হোক। একই অবস্থা হয়েছে বয়স্কদেরও। উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বয়স্করা। ওনারাও খুবই বিপদে আছেন এই প্যানিক বাইয়ের ফলে। উপায়ান্তর না দেখে দোকানগুলোতে এলডারলি শপিং আওয়ার চালু করেছে কিন্তু সেটা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। আবার জনপ্রতি জিনিসপত্রের লিমিট করে দেওয়াতে ওনারা বেশি কিনতেও পারছেন না। একটা নিউজে দেখলাম, এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা বলছেন, ‘আমি আমার বৃদ্ধা মাকে এই সাতসকালে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি কারণ জনপ্রতি লিমিট করে দেওয়া হয়েছে। এখন যদি এখানে কোনো কিছু না পায়, তবে আবারও আমাকে অন্য শপিংমলে ছুটতে হবে যেটা আমার মায়ের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির।’
অস্ট্রেলিয়াতে এখনো স্কুল, কলেজ বা অফিস রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি, তবে অনেক অফিসই তাদের কর্মীদের বাসা থেকে অফিস করার নির্দেশনা জারি করেছে। আমাদের মেয়েটা কয়েক দিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে কবে স্কুল ছুটি দেবে আবার পাশাপাশি করোনার কারণে বাতিল হয়ে যাওয়া অ্যাথলেটিক কার্নিভালের জন্য পস্তাচ্ছে। স্কুলগুলো এখনো করোনার প্রভাব থেকে মুক্ত রয়েছে তবে দিনে দিনে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। বাস-ট্রেনে কেউ হাঁচি বা কাশি দিলে সবাই আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। ঋতু পরিবর্তনের ধারায় অস্ট্রেলিয়াতে শীতকালের আগমনধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই ভোরবেলায় চারিদিক কুয়াশায় ঢেকে থাকে। সামান্য হাঁচি-কাশি এ সময় খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু করোনার প্রভাবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় ভীতির কারণ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে আপনি ট্রেনে বসে যদি একটা হাঁচি বা জোরে কাশি দেন, তাহলে আগে যেখানে পাশের মানুষটা ‘ব্লেস ইউ’ বলত, এখন সেখানে সবাই সেই বগি ছেড়ে চলে যায়।
অস্ট্রেলিয়াতে লেভেল-৩ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে একেবারে প্রয়োজনীয় কিছু সুযোগ-সুবিধা ছাড়া মোটামুটি সবকিছুই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর যেসব সুবিধা খোলা রাখা হয়েছে সেখানেও সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। শপিং সেন্টারগুলোতে মার্ক করে দেওয়া হয়েছে একজন ক্রেতা সামনে দাঁড়ালে তাঁর পেছনে ঠিক কোন জায়গায় অন্যজন দাঁড়াতে পারবেন। বেচাকেনাতেও কিছু নিয়ম আরোপ করা হয়েছে—যেমন একজন ক্রেতা মাত্র একটাই টয়লেট টিস্যুর বাক্স কিনতে পারবেন। ঠিক একই রকম বিধি আরোপ করা হয়েছে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রেও, যাতে করে কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়। বেশির ভাগ অফিসই তাদের কর্মীদের বাসা থেকে অফিস করার পরামর্শ দিয়ে দিয়েছে। আর যেগুলো খোলা আছে সেখানে সামাজিক দূরত্ব এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
সরকারিভাবে এখনো স্কুলগুলো বন্ধ করা হয়নি, তবে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। স্কুলগুলো মূলত খোলা রাখা হয়েছে যাতে করে এই দুর্যোগের সময়ও যাঁরা কাজ করছে তাঁদের বাচ্চাগুলো যেন একটা শেল্টার পায়। সব স্কুলই তাদের ছাত্রছাত্রীদের বাড়ির কাজ বা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেছে। বাচ্চারা সারা দিন বাসায় সময় কাটাচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যেই অনেকে সমুদ্রসৈকতে গিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছিল। পরবর্তী সময়ে সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই হওয়ার পর সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে গেছে। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার একটা রাজ্যে একজন প্রতিবেশী অন্য একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে আলাপ করায় তাঁদের জরিমানা করেছে। রাস্তাঘাটগুলোতে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন বা কোথা থেকে আসছেন। উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারলে সেখানেও ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে জরিমানার টিকিট।
সিডনিতে বছরজুড়েই বিভিন্ন রকমের মেলা বা অনুষ্ঠান চলে। এবারের সব অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া শীতকালে নগরকে ব্যস্ত রাখার জন্য যেসব বাড়তি আয়োজন করা হয় সেগুলোও একে একে বাতিল করা হচ্ছে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সিডনি নগরী এখন অনেকটাই ভুতুড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে পুরো শহরই যেন কোয়ারেন্টিনে আছে। ডিপার্টমেন্ট অব হেলথের আপডেট অনুযায়ী (৩০ মার্চ) অস্ট্রেলিয়াতে ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করে ৪ হাজার ৯৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে, যার মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে করে তারা কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক রেস্তোরাঁ খাবার রান্না করে একেবারে বিনা মূল্যে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে বিশেষ করে বয়স্কদের। বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস এবং তাঁর স্ত্রী রিটা উইলসন অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিলেন একটা চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের কাজে। পরবর্তী সময়ে ওনাদের দুজনেরই করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে গত ১১ মার্চ। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর ওনাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওনারা নিজ দেশ আমেরিকা পৌঁছেই অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।
করোনার এই প্রাদুর্ভাবেও কিছু ভালো খবর মানব সভ্যতাকে ভাবিত করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু ভালো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন প্রকৃতি যেন এই সুযোগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রথমবারের মতো গাঙ্গেয় শুশুক (এক শ্রেণির ডলফিন) দেখা গেছে। পরিবেশবিদদের ধারণা, মানুষের কোলাহল কমে যাওয়াতেই শুশুকেরা ফিরে এসেছে। ঠিক একই রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার অনেক সমুদ্রসৈকতের ক্ষেত্রেও। মানুষের কম চলাচলের ফলে বায়ুদূষণের মাত্রাও রাতারাতি অনেক কমে গেছে। এমন আরও বেশ কিছু ভালো পরিবর্তন মানুষকে ভাবাচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। জানি না করোনা ভাইরাসের কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষাটা মানুষ কত দিন ধরে রাখতে পারবে।
তবে মানব সভ্যতার এই ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাপী এখনো সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা যাঁর মধ্যে আছেন চিকিৎসক, নার্স এবং আরও অনেকে। তাঁরা তাঁদের নিজের, পরিবারের, সমাজের বা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। অনেকেই আবার এই রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজের দেহে রোগের সংক্রমণের ফলে মৃত্যুবরণও করেছেন। ভয়াবহ এই দুর্যোগের সময়ে এক শ্রেণির মানুষ যেমন ঘরে গাদা গাদা খাবার মজুদ করে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করছেন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন, ঠিক তেমনি অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর্মীরা আবারও আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবতার ঝান্ডা উড়িয়ে এবং দিন শেষে মানবতায় জয়ী হবে, কারণ ইতিহাস সেটাই সাক্ষ্য দেয়। করোনার প্রভাবও মানুষ একসময় কাটিয়ে উঠবে, তবে রেখে যাবে কিছু ক্ষত।