করোনাকালের শিক্ষা ও করণীয়
‘ইতিহাসের শিক্ষাই এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’—বহুল ব্যবহৃত এ কথাটা মনে রেখেই ত্রাসসঞ্চারী করোনাভাইরাস পৃথিবীকে যেভাবে বুঝিয়ে দিল, প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচারের ফল কী হতে পারে, কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গসহ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আন্দোলনকারী হাজার হাজার কণ্ঠের আকুতি তা পারেনি। আমরা কেবল কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করে নিয়মিত জলবায়ু সম্মেলন করেছি, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছি, বাস্তবায়ন হবে না জেনেও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর বিলাসী জীবনের উপকরণ জোগাতে প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি, বায়ুমণ্ডলকে বিষিয়ে তুলেছি। আমরা কি এখন বুঝতে পারছি যানবাহন কম চলাচল করলে বা আকাশে বিমান কম ওড়াউড়ি করলে প্রকৃতি কত সুন্দর ও নির্মল হয়ে ওঠে?
সভ্যতার বিকাশ ও মানুষের ভোগবিলাসের জোগান দিতে আমরা প্রকৃতির ওপর অনেক অত্যাচার করেছি। সর্বংসহা ধরিত্রী এত দিন মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। এবার যা ঘটছে, তা হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতির কাছে আমরা কত অসহায়! এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার কেবল মানুষের নয়, পশু-পাখি, গাছপালা, নদী-সমুদ্র, বন উপবন, জীব-জন্তু সবারই সমান অধিকার আছে এ পৃথিবীতে আপন আপন নিয়মে বসবাস করার। এ সত্যটি কম আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি না?
গোটা পৃথিবীর মানুষের মতো বাংলাদেশেও আমরা এখন বন্দী জীবন যাপন করছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ইতিমধ্যে অনেকেই আমরা এমন জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমরা জানি না, কত দিন এ অবস্থা চলবে। কেবল একটাই জানি, এভাবে থাকা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। হতাশার মাঝেও আমাদের আশা এ কৃষ্ণপক্ষের অবসান একদিন হবেই।
আমাদের এখন প্রধান করণীয় গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের রক্ষা করা। একা সরকারের পক্ষে এ বিরাট কাজ করা সম্ভব নয়। সমাজের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফোনে আলাপ–আলোচনা করে নিজ নিজ এলাকায় সমন্বিত সহায়তা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। ত্রাণ বিতরণেও নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ বিতরণের ছবি কাগজে বা ফেসবুকে প্রকাশের লজ্জাজনক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। যাঁরা গোপনে মানুষকে সাহায্য করেন, তাঁদের আমি নতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে এমন মানুষেরাও আছেন, যাঁদের আশু আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। আমরা যদি নিজ নিজ সংগঠন থেকে এর তালিকা করে কেন্দ্রীয়ভাবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে জানাই, তবে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। গোলাম কুদ্দুছ ইতিমধ্যে একটা তালিকা করে আসাদুজ্জামান নূরকে দিয়েছেন; নূর এ ব্যাপারে সমন্বয় করবেন।
সম্প্রতি পোশাকশিল্পের মালিকেরা হাজার হাজার কর্মীর সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করলেন, এর দায় কে নেবে? কোনো সমন্বয় ছাড়াই কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? শ্রমিকেরা এত কষ্ট করে কারাখানায় পৌঁছে দেখলেন, কারখানা বন্ধ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ওই দিন মার্চ মাসের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত না? পোশাকশিল্পের মালিকেরা কী এমনই বিত্তহীন যে মাস দু–তিনেক তাঁরা কর্মচারীদের নিজেদের তহবিল থেকে বেতন দিতে পারেন না?
এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্থনীতি চালু রাখার জন্য যে প্যাকেজগুলো ঘোষণা করেছেন, তা অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত। সেখানেও কিন্তু সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এ প্যাকেজের টাকা যেন কেবল কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, তার জন্য কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত বলে পোশাকশিল্পের মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে।
আবারও বলি, এ সংকট একদিন কাটবেই। পৃথিবী নির্মল হবে, পাপমুক্ত হবে। বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে আমরা গাইতে চাই:
‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে...
বৎসরের আবর্জনা
দূর হয়ে যাক যাক যাক...
এসো এসো...
এসো হে বৈশাখ...’
অমানিশা শেষে আবারও ভোর হবে জানি। আসবে নতুন পৃথিবী এক। নতুন সে পৃথিবীতেও মানুষ ঠিকই হেসে-খেলে-নেচে-গেয়ে উদযাপন করবে জীবনের জয়গান।
নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা।