করোনার ভারতীয় ধরন, বাংলাদেশের জন্য কতটা শঙ্কার
ভারতে সক্রিয় করোনাভাইরাসের নতুন দুটি ধরনের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো এটি দ্রুত ছড়ায়। আজ সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় ধরনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই বলে মনে করছেন অণুজীববিজ্ঞানী, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁরা মনে করছেন, বাংলাদেশও শঙ্কামুক্ত নয়।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের শঙ্কা পশ্চিমবঙ্গকে নিয়েই বেশি। ভাইরাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। অনেক দূরের ধরন বাংলাদেশে এসেছে। তাই সঠিক ব্যবস্থা না নিলে এটিও বাংলাদেশে আসতে পারে। স্থলবন্দরের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা অধ্যাপক নজরুলের কাছে শঙ্কার বড় কারণ। তিনি বলছিলেন, আকাশপথে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন মোটামুটি হলেও স্থলবন্দরে এ ব্যবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। তাই এ পথে দ্রুত কঠোর কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দুটি ধরনের সন্ধান বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে অণুজীববিজ্ঞানী, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের কথা, বাংলাদেশকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। কারণ, দুটি ধরনের মধ্যে একটি বাংলাদেশের কাছের পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয়। তাই সীমান্তে কড়াকড়ি, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা এবং প্রতিনিয়ত জিন নকশার উন্মোচন ও নজরদারি করতে হবে। ওই দুই ধরনের একটিও বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল হলে তা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ভারতের ধরন ঠেকাতে বাংলাদেশ আকাশ ও স্থলপথে ভারতের সঙ্গে সব ধরনের চলাচল বন্ধ রেখেছে। ইউরোপে ভারতীয় ধরন নিয়ে সতর্কতা জারি হয়েছে। জার্মানিসহ আরও কয়েকটি দেশ আজ থেকে ভারতের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ ভারতের মহারাষ্ট্র ও দিল্লির পাশাপাশি ব্যাপক হারে করোনা বাড়ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজার ৮৫৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫৯ জন। দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় সংক্রমণের হার বেড়েছে ২৫৩ শতাংশ। ভারতে তিন দিন ধরে করোনার সংক্রমণ একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টি করছে। বিশ্বের কোনো দেশে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা রোগী শনাক্তের রেকর্ডটি গত বৃহস্পতিবারের আগপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিল। দেশটিতে গত জানুয়ারিতে এক দিনে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার ভারতে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৫ জন রোগী শনাক্ত হন। শনাক্তের নিরিখে ভারত সেদিন রেকর্ড ভাঙে।
ভারতে সক্রিয় ধরন দুটি নিয়ে যা বলছেন দেশের বিজ্ঞানীরা
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন নকশা উন্মোচন) হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করোনার যত জিন নকশা উন্মোচন করেছে, সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছে সিএইচআরএফ। সেঁজুতি সাহা গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে দুটি ধরন নিয়ে কথা হচ্ছে। এ দুটি হলো বি ১.৬১৭ ও বি ১.৬১৮। আমরা এর মধ্যে কোনোটি বাংলাদেশে পাইনি।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ভারতীয় ধরন এ দেশে পাননি। এর মধ্যে বিসিএসআইআর করোনাভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচনের কাজ করছে বেশ কিছুদিন হলো।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে ধরন দুটি না মিললেও বাংলাদেশের শঙ্কার বড় কারণ আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, নতুন দুই ধরনের বিস্তার অনেক বেশি।
ভাইরাস তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই জিনগত পরবির্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনকে মিউটেশন বলা হয়। পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন নতুন ধরন সৃষ্টি হয়। এসব ধরন বেশি আগ্রাসী হতে পারে আবার কমও হতে পারে।
সেঁজুতি সাহা বলছিলেন, ভাইরাসের বিভিন্ন রূপ এখন রয়েছে। আর রূপগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যদি কোনো ধরনকে ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন বলা হয়, এর অর্থ এই নয় যে এগুলো কেবল সেই দেশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে আসার পর সব লোককে বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা দরকার। কোন ধরন কখন, কীভাবে ছড়াবে, তা বলা মুশকিল।
করোনা সংক্রমণের হার ২ শতাংশে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশে চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। চলতি এপ্রিল মাসে দৈনিক সংক্রমণ সাত হাজারের সীমা অতিক্রম করে। মৃত্যু শ পেরোয়। শনাক্ত ও মৃত্যুর এ সংখ্যা ১৩ মাস ধরে বাংলাদেশে চলা করোনা সংক্রমণকালে কখনোই ঘটেনি। চলতি এই বৃদ্ধিকে করেনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ ’ বলা হচ্ছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢিলেঢালা ভাব আমাদের সব সময় ছিল। আমরা নিজেরা অনেক কিছু মানি না। তাই দেশের বাইরে থেকে যারা এসেছে তারাও তা মানেনি।’
মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের সংক্রমণ রোধে আগে কঠোর হতে হবে। বিধি–ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে। যথেচ্ছ চলাফেরা করা হলে তা হবে না। মহামারি ঠেকানো যায় না। মহামারির সময় একটি ভাইরাস অন্য দেশে চলে আসে। এই আসাটা যত বিলম্বিত করা যায়, ততই মঙ্গল। আর আমাদের সংক্রমণে রাশ টানতে না পারলে অন্য ধরন এসে তো পরিস্থিতি আরও নাজুক করতে পারে।’
দেশে করোনা সংক্রমণ কমাতে না পারলে দেশেই নতুন ধরন তৈরি হতে পারে, মনে করেন সেঁজুতি সাহাও। তাঁরও পরামর্শ, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কড়াকড়ি করা। পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার দিকে নজর দেওয়া।
মুশতাক হোসেন এবং সেঁজুতি সাহার মত হলো, প্রতিনিয়ত করোনার জিন রহস্য উন্মোচনের কাজটি করে যেতে হবে। আর এর নজরদারি রাখতে হবে। এ–সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে। আবার তাঁদেরও এসব তথ্যকে মূল্যায়ন করতে হবে।
ভারতের পরিস্থিতির দিকে সরকারি নজর কতটুকু? এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সরকারের কাছে কোনো বার্তা দিয়েছে?
মুশতাক হোসেন বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আইইডিসিআরের কেউ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাননি।