এখন গ্রামেও সংক্রমণ বাড়ছে
রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ ও খুলনায় গ্রামের দিকে করোনার বিস্তৃতি বেড়ে গেছে।
পলিথিনে ঢাকা সারি সারি নতুন কবর। হঠাৎ দেখলে গণকবর বলে ভ্রম হতে পারে। কবরগুলো রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী কবরস্থানের। সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক মমতাজ উদ্দিন বললেন, ১৮ বছরের চাকরিজীবনে এত নতুন কবর তিনি দেখেননি। এর দেড় কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় কবরস্থান। সেখানেও নতুন কবরের সারি।
মহিশালবাড়ী কবরস্থানে গত দেড় মাসে কবর হয়েছে ৪০টি। আর গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় কবরস্থানে গত এক মাসেই ৩৮টি কবর হয়েছে। কবরস্থান কমিটির ভাষ্য, ৪০ জনের ২১ জন আর ৩৮ জনের মধ্যে ২৪ জন করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এই চিত্র বলছে, শহরের পাশাপাশি করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু এখন গ্রামাঞ্চলেও বেড়ে চলেছে। রাজশাহী ছাড়াও ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ ও খুলনা জেলার গ্রামাঞ্চলেও করোনার বিস্তৃতি বেড়ে গেছে। অনেক উপজেলায় সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কিন্তু সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে উপসর্গ থাকার পরও অনেকে করোনা পরীক্ষা করতে চান না। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারেও উদাসীনতা দেখা যায়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ প্রবণতাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন। তাঁরা উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সরবরাহ, অক্সিজেন মাস্ক, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করাসহ চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে দিতে না পারায় এমন পরিস্থিতি ঘটেছে। সীমান্তের উপজেলা ও জেলাগুলোতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াতে হবে।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৮৪০ জনের।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, দুই-তিন সপ্তাহ ধরে এ হাসপাতালে যেসব রোগী করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী। জেলা সিভিল সার্জনের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মে পর্যন্ত জেলার ৯ উপজেলায় মোট শনাক্ত করোনা রোগী ছিল ১ হাজার ৫৭৬ জন। মৃত্যু ছিল ২৭ জনের। শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যুর হার ছিল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর ১ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত এই ৯ উপজেলায় শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৫৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গ্রামপর্যায়ের শ্রমজীবী মানুষ এবার বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। মারাও যাচ্ছেন। গ্রামের মানুষের নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহ কম।
গোদাগাড়ীর দুই কবরস্থানে করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর ওই পরিসংখ্যানের সঙ্গে সরকারি হিসাবের অমিল রয়েছে। সরকারি হিসাবে গোদাগাড়ীতে এ পর্যন্ত করোনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় অনেকে বলছেন, হাসপাতালে মারা গেলেও মৃত্যুর পরে করোনা পরীক্ষা করা হয়নি। তাই সরকারি তালিকায় তাঁদের নাম ওঠেনি।
মহিশালবাড়ী কবরস্থানের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. নওশাদ আলী দাফন করা প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর দিন, তারিখ ও কে কীভাবে মারা গেলেন, তা লিখে রাখেন। তাঁর খাতার হিসাব বলছে, গত মে মাসে এই কবরস্থানে ২৩ জনকে দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায়, ৫ জন বার্ধক্যজনিত কারণে ও ৪ জন অজ্ঞাত কারণে মারা গেছেন। বাকি ১১ জন করোনা অথবা করোনা উপসর্গে মারা গেছেন। চলতি মাসে (১৭ জুন পর্যন্ত) ১৭ জনকে দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন করোনা বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
গোদাগাড়ী কেন্দ্রীয় গোরস্থানের (ফাজিলপুর) সাধারণ সম্পাদক আকবার আলী বললেন, ঈদের দুই দিন পর থেকে এই কবরস্থানে মোট ৩৮ জনকে দাফন করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ জনের স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। বাকিরা করোনা বা করোনা উপসর্গে মারা গেছেন।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন কাইয়ুম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মানুষ কম সচেতন, মাস্ক পরেন না। গ্রামের মানুষের মধ্যে নমুনা পরীক্ষায়ও আগ্রহ কম। একেবারে উপসর্গ দেখা দিলে তাঁরা করোনার পরীক্ষা করান। এ কারণে শনাক্তের হার বেশি, মৃত্যুহারও বেশি।
ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-গলাব্যথা
ঠাকুরগাঁওয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। শহর থেকে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। সেখান থেকে আমজানখোর রত্নাই বাবুগছ আরও ১৮ কিলোমিটার। গত সোমবার ওই এলাকার একটি পরিবারের তিনজন করোনায় আক্রান্ত হন। উপজেলা প্রশাসন ওই বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে।
জেলার সদর উপজেলা, বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল ও হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বাড়ি বাড়ি কেউ না কেউ জ্বর-সর্দি, গলাব্যথা, মাথাব্যথায় ভুগছেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, আগে গ্রামের মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কম ছিল। কিন্তু গত মে মাসের শেষ দিক থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলা সদরের মানুষের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষই বেশি।
হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, এখন প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৮০ থেকে ১০০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এসব রোগীর অর্ধেকের বেশি সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন মাহফুজার রহমান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সবখানেই করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিস্তার ঠেকাতে জেলায় সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।
নমুনা পরীক্ষায় অনাগ্রহ
নওগাঁ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ১ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত নওগাঁয় ৩ হাজার ৩৯০টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ৯৬৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলায় আছেন ১৭৮ জন। বাকি ৭৮৫ জন ১০ উপজেলার বাসিন্দা। এই হিসাবে, নওগাঁ সদর উপজেলায় ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং ৮১ দশমিক ৫১ শতাংশ বাকি সব উপজেলার রোগী।
নওগাঁ জেলা সদরে চলতি মাসে যেখানে ১৭৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেখানে জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা নিয়ামতপুরে শনাক্ত হয়েছে ১৯২ জন। এই চিত্রই বলে দেয়, শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামেও বাড়ছে করোনা রোগী।
শুধু নিয়ামতপুরই নয়, জেলার অন্য উপজেলায় হঠাৎ বেড়ে গেছে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। উপসর্গ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
নওগাঁর সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ বলেন, জ্বর ও সর্দি-কাশি নিয়ে আগের চেয়ে বেশি মানুষ হাসপাতালে আসছেন।
গ্রামে বাড়ছে সংক্রমণ
সাম্প্রতিক সময়ে খুলনা শহরের চেয়ে উপজেলাগুলোতে করোনায় মৃত্যু বেশি দেখা যাচ্ছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি জুন মাসের প্রথম ১৬ দিনে নগর ও জেলা মিলিয়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮১৮ জনের। এর মধ্যে নগরে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৪৬ জনের আর ৯টি উপজেলায় শনাক্ত হয়েছে ৪৭২ জনের। এই হিসাবে জুনের ১৬ দিনে জেলার মোট শনাক্তের প্রায় ৭৪ শতাংশ নগরের এবং ২৬ শতাংশ উপজেলার রোগী। এই সময়ে জেলায় করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়া ২৩ জনের মধ্যে নগরের ১১ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার ১২ জন রয়েছেন।
তেরখাদা উপজেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আগের চেয়ে শনাক্ত অনেকে বেড়েছে। জ্বর ও সর্দি-কাশি নিয়ে আগের চেয়ে বেশি মানুষ হাসপাতালে আসছেন।
খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, উপজেলাগুলোতে গত মাসের শেষ দিক থেকে চলতি মাসজুড়ে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়েও উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো, এসব কারণেই গ্রামে সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]