আমরা স্কুলে ফিরতে চাই

শিক্ষকদের আসার অপেক্ষায় খুদে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখক
শিক্ষকদের আসার অপেক্ষায় খুদে শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখক

নিউইয়র্ক সিটির শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করছে দীর্ঘ তিন মাস। এতটা সময় তারা তাদের শিক্ষক, সহপাঠীদের সংস্পর্শ থেকে আগে কখনো দূরে থাকেনি। এ দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল, শিক্ষক ও সহপাঠীদের ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে স্কুলে কর্মরত অন্য সবাইকে। এমনকি স্কুল সেফটি এজেন্টও এই ভালোবাসার বাইরে নয়। রোজ স্কুলের শুরুতে শিক্ষার্থীরা সবাইকে শুভ সকাল জানিয়ে দিন শুরু করে। আবার ছুটির সময় বিদায় নেওয়ার আগে শ্রেণিশিক্ষককে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয়। শীতপ্রধান এই দেশে কখনো কখনো ঠান্ডাজনিত শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও স্কুল কামাই দিতে অপারগ এ দেশের শিশুরা।

স্কুল চলার সময়টুকু শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় করে তুলতে শিক্ষকেরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন। মোদ্দাকথা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্কটি প্রগাঢ় মমতার। একই সঙ্গে স্নেহের, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার। এই স্কুলপাগল শিশুরা দীর্ঘ তিনটি মাস ভেতরে কতটা ক্ষরণ পুষে রেখে বাড়িতে বসে অনলাইনে ক্লাস করছে, তা কেবল তারাই জানে। আমারও কিছুটা উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল বলে এই লেখার অবতারণা।
১২ জুন শুক্রবার ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখি মুঠোফোনে খুদে বার্তা। আমার চতুর্থ গ্রেড পড়ুয়া ছোট পুত্র রিহানের শ্রেণিশিক্ষক মিস সুয়ারিজ লিখেছেন, ‘দুপুর ১২টায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দেখতে চাই। আমরা ওপথ দিয়ে যাব, তোমরা পথের পাশে অপেক্ষা করো।’ খুদে বার্তার সঙ্গে একটি মানচিত্রও দেওয়া হয়েছে। সেখানে লাল দাগে শনাক্ত করে দেখানো হয়েছে শিক্ষকেরা কোন কোন পথে অতিক্রম করবেন। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিই। রিহান যারপরনাই আনন্দিত। বহুদিন পর সে তার শিক্ষকদের দেখবে। তার আনন্দ আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়।

নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মা-ছেলে বাসার পাশের বড় সড়কের মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই। যেহেতু এলিমেন্টারি স্কুলগুলো জোনভিত্তিক, তাই স্কুলের আশপাশেই শিক্ষার্থীদের বসবাস। সব খুদে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কাছ হতে প্রযুক্তির মাধ্যমে বার্তা পেয়ে মা–বাবার সঙ্গে একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সড়কের দুই পাশে অবস্থান নেয়।

মুখে মাস্ক পরিহিত শিশুদের হাতে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। সেগুলোয় লেখা, ‘আমি আমার স্কুল ভালোবাসি, আমি তোমাদের মিস করি, আমি আবার স্কুলে ফিরে যেতে চাই, আমাদের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছ বলে ধন্যবাদ জানাই।’ জংশন ব্লুবার্ডের দুই পাশের ফুটপাতে শিশুদের এমন আবেগঘন লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমার ভেতরটা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। চোখের কোণে আর্দ্রতা টের পাই। ছোট্ট রিহানের দুই চোখ ডানে–বাঁয়ে, চক্রাকারে খুঁজে বেড়ায় তার সহপাঠীদের। কিন্তু মাস্কে আবৃত অবয়বগুলো কেউ কাউকে চিনতে পারে না। মা–বাবার হাত ধরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। ঘড়িতে যখন ১২টা বেজে ২০, ঠিক তখনই আকাশ–বাতাশ কাঁপিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে গাড়িগুলো। প্রথমে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের গাড়ি, তারপর একে একে শিক্ষকসহ স্কুলে কর্মরত সবার গাড়ি। শিক্ষকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলো সাজিয়েছেন নানান রঙের বেলুন আর পোস্টারে। সেখানেও আবেগঘন লেখা। ‘আমরা তোমাদের মিস করি, শক্ত থাকো, নিরাপদ থাকো, আমরা তোমাদের ভালোবাসি’—পোস্টারের এমন লেখাগুলো যখন পড়ছিলাম, তখন সড়কের দুই পাশে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের উৎসুক চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাদের নিজ নিজ শ্রেণিশিক্ষককে। শিক্ষকেরা কেউ কেউ ছাদখোলা গাড়ির ভেতর থেকে গলা উঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে হাত নাড়ছিলেন। কেউবা গাড়ির জানালায় অর্ধেক শরীর বের করে আনন্দধ্বনি দিচ্ছিলেন। আবার কেউ খোলা জিপে চড়ে মিউজিক বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন। অনেক দিন পর তাঁরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের দেখা পেয়েছেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! অন্যদিকে সড়কের দুই পাশে অপেক্ষারত শিশুরাও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছিল, ফ্লাইং কিস দিচ্ছিল শিক্ষক ও স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

শিক্ষকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলো সাজিয়েছেন নানান রঙের বেলুন আর পোস্টারে। সেখানেও আবেগঘন লেখা। ছবি: লেখক
শিক্ষকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলো সাজিয়েছেন নানান রঙের বেলুন আর পোস্টারে। সেখানেও আবেগঘন লেখা। ছবি: লেখক

আচমকা ছোট্ট রিহান উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘হাই, মিস সুয়ারিজ!’ মাত্র একপলক! মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস পরিহিতা মিস সুয়ারিজ শিশুদের উদ্দেশে শূন্যে হাত নাড়ছিল, চুমু ছুড়ে দিচ্ছিল। মুহূর্তেই গাড়িটি মিলিয়ে গেল করোনা অ্যাভিনিউয়ের দিকে, অন্য গাড়িগুলোর ভিড়ে। আমি রিহানের দিকে ঘুরে তাকাই। চোখে মুখে তীব্র উচ্ছ্বাস, আনন্দ। আলোর ঝলকানির মতো একপৃথিবী বিস্ময় নিয়ে সে আমায় বলে ওঠে, ‘আম্মু, আমি মিস সুয়ারিজকে দেখেছি, তুমি দেখেছ?’ আমি উত্তর দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ততোধিক বিস্ময়ে নয় বছরের এই সহজ–সরল বালকের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকি সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটির দিকে। এ দেশের শিশুরা তাদের শিক্ষকদের কতটা ভালোবাসে, তা আবারও নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো।


১০ মিনিটব্যাপী একে একে গাড়িগুলোর চলে যাওয়া দেখি। দেখি ছোট ছোট শিশুদের চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে বাড়ির দিকে ফেরার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাদের কেউ কেউ ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিল শিক্ষকদের দেবে বলে। যদিও তা আর দেওয়ার সুযোগ হয়নি কারোর। দীর্ঘদিন আতঙ্ক, ভয় আর বিষণ্ণতার চাদরে ঢাকা এই সব শিশু ঘরবন্দী থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আগের মতো মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে, ছুটোছুটি খেলতে চাইছে সহপাঠীদের সঙ্গে। স্কুল শেষে শ্রেণিশিক্ষককে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিতে চাইছে। কিন্তু করোনাভাইরাস নামের অণুজীবের কাছে তাদের চাওয়াগুলো বড় বেশি অসহায়!