করোনা চিকিৎসা
আইসিইউর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মৃত্যু
মৃত্যু বাড়ছে জেলায় জেলায়। ৩৬টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউই নেই। কিছু হাসপাতালে নেই হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা। চিকিৎসকের অভাব প্রকট।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে আটটি। গতকাল বৃহস্পতিবার আইসিইউর জন্য অপেক্ষাধীন ছিলেন ৯৫ জন সংকটাপন্ন রোগী।
এ তালিকা থেকে সাতজনের নাম ও মুঠোফোন নম্বর নিয়ে ফোন করে জানা যায়, অন্তত পাঁচজন আইসিইউর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বিগত তিন–চার দিনের মধ্যে।
মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একজন জেলার শ্যামনগর উপজেলার হাফিজা বেগম (৬০)। তাঁর ছেলে ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মা মারা গেছেন। আইসিইউতে একটা শয্যার জন্য কতজনের কাছে গেছি। কিন্তু মায়ের জন্য একটা শয্যা জোগাড় করতে পারিনি।’
চিকিৎসকেরাও মৃত্যু নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁরাও বলছেন, আইসিইউ বাড়ানো দরকার। সাতক্ষীরা মেডিকেলের আইসিইউর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সাইফুল্লাহ বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। দেখা যায়, রোগীর জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ দরকার। তবে শয্যা খালি নেই। রোগী একপর্যায়ে মারা যান। তিনি আরও বলেন, আইসিইউতে শয্যা বাড়ানো দরকার। সঙ্গে দরকার বাড়তি চিকিৎসক।
এ রকম আইসিইউর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অনেক জেলা হাসপাতালেই আইসিইউ সুবিধা নেই। সেখান থেকে সংকটাপন্ন রোগীকে দূরের জেলায় নিতে হচ্ছে। কিন্তু আইসিইউর নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে, সেখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি। চিকিৎসকেরা রোগীকে আইসিইউতে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। স্বজনেরা আইসিইউর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। কাকুতিমিনতি করছেন, কাজ হচ্ছে না। কারণ, শয্যা খালি নেই। তারপর আসছে মৃত্যুর খবর।
অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। দেখা যায়, রোগীর জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ দরকার। তবে শয্যা খালি নেই। রোগী একপর্যায়ে মারা যান।ডা. সাইফুল্লাহ, আইসিইউ ওয়ার্ড, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সাতক্ষীরা ছাড়াও দেশের ১০টি জেলার হাসপাতালের চিকিৎসাসুবিধা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে গতকাল দেখা গেছে, সংকট শুধু আইসিইউতে নয়, অনেক হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। ফলে চালানো যাচ্ছে না হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা। প্রায় সব হাসপাতালেই রয়েছে চিকিৎসক–সংকট। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। রোগীদের অভিযোগ, রাতে তেমন কোনো সেবা পাওয়া যায় না। রাতে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মৃত্যু বেশি, আইসিইউতে চাপ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরের জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা গেছেন কুমিল্লায়, ১৭ জন। কুমিল্লার কোভিড হাসপাতালে শয্যা আছে ১৪২টি, আইসিইউ ২০টি। প্রতিদিনই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে সংকটাপন্ন রোগীরা সেখানে চিকিত্সার জন্য যান। কিন্তু সহজে আইসিইউ পাওয়া যায় না।
হাসপাতালটির চিকিত্সক ও বিএমএ কুমিল্লা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, আইসিইউর জন্য রোগী ও তাঁদের স্বজনদের প্রচণ্ড চাপ। প্রতিদিনই অন্তত ৩০ জন রোগী আইসিইউএর জন্য অপেক্ষায় থাকেন।
মৃত্যুর দিক দিয়ে গতকাল দ্বিতীয় ছিল খুলনা। জেলায় মারা যান ১২ জন। খুলনায়ও আইসিইউর সংকট তীব্র। সেখানকার দুটি সরকারি হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। তবে রোগীর চাপ অনেক বেশি। শয্যা খালি পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রামে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। সেখানে বেশ কয়েক দিন ধরে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউর শয্যার সংকট তীব্র। ঢাকা জেলার মধ্যে গতকাল মহানগর বাদে সবচেয়ে বেশি (সাতজন) রোগীর মৃত্যু হয় রাজবাড়ীতে। সেখানে জেলা হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ শয্যা রয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম ও জনবল নেই। ফলে আইসিইউ চালু করা যায়নি।
কিছু কিছু হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নিবেদিত ওয়ার্ডে সাধারণ শয্যা ফাঁকা। তবে আইসিইউতে শয্যা খালি পাওয়া কঠিন। তেমন একটি হাসপাতাল হলো ফরিদপুর জেলা হাসপাতাল। এ হাসপাতালে আইসিইউ ওয়ার্ডে মোট শয্যা আছে ১৬টি। এ ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক অনন্ত বিশ্বাস বলেন, ‘প্রতিদিন আইসিইউতে স্থান পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ পর্যন্ত দাঁড়ায়। শয্যা খালি না হওয়া পর্যন্ত আমরা তো নতুন রোগীকে জায়গা দিতে পারি না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ১০২টি হাসপাতালের মধ্যে ৪৯টিতে আইসিইউ সুবিধা নেই। এর মধ্যে ৩৬টি হাসপাতালই জেলা সদর হাসপাতাল। সম্প্রতি খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে মৃত্যু বেশি হয়েছে। এ দুই বিভাগের ১৮ জেলার মধ্যে ১০টিতেই সরকারি ব্যবস্থাপনার করোনা হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। এসব জেলা হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট সদর হাসপাতাল এবং খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও মাগুরা সদর হাসপাতাল।
হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থাও নেই
কোনো জেলা হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা না থাকায় হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে রোগীদের আইসিইউ তো দূরের কথা, উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেনও দেওয়া যাচ্ছে না। যেমন বরিশালের ঝালকাঠি জেলা হাসপাতালে দুটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে। তবে তা কাজে লাগছে না কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা না থাকায়।
অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, একজন রোগীর মিনিটে ১৫ লিটারের মতো অক্সিজেন দরকার পড়লে সিলিন্ডার থেকে সরবরাহ করা যায়। আবার সিলিন্ডার না থাকলে বিকল্প হিসেবে এ চাহিদা পূরণ করতে পারে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। এটি বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রোগীকে সরবরাহ করে। আর মিনিটে ৩০ লিটারের মতো অক্সিজেন লাগলে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ব্যবহার করা হয়। এটির জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন পাইপলাইন দরকার হয়।
প্রথম আলো ৪ জুলাই সব কটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল, তখন ১৭টি জেলায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা ছিল না। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ২ জুন এক সভায় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন ও উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা বাড়াতে বলেন।
চিকিৎসকের ঘাটতি, শয্যারও অভাব
জেলা হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যারও অভাব দেখা দিচ্ছে। নিয়মিত বিরতিতে করোনার সাধারণ শয্যার সংখ্যা বাড়ানোও হচ্ছে। তবু কোনো কোনো জায়গায় রোগীর ঠাঁই হচ্ছে মেঝেতে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বড় সমস্যা হলো চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবলের সংকট প্রকট। পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের পরিস্থিতির যথাযথ তদারকি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক–সংকটের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছে।
যেমন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের পদ ২৩টি। চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৯ জন। জেলাটিতে গতকাল রোগী শনাক্তের হার ছিল ৩৪ শতাংশ। একই পরিস্থিতি ভোলা সদর হাসপাতালে। এ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা নিরুপম বলেন, করোনা ইউনিটে সংকটের শেষ নেই। আইসিইউ শয্যাগুলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে চালু করা যায়নি। তিনি বলেন, শুধু মেডিকেল অফিসার দিয়ে হাসপাতাল চলে না। করোনা ইউনিটে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতাল কাগজে–কলমে ১০০ শয্যার। তবে চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে। জেলার সিভিল সার্জন নূপুর কান্তি দাশ বলেন, আইসিইউ ব্যবস্থা থাকলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় চালু করা যাচ্ছে না।
সুপারিশ ও বাস্তবতা
কুষ্টিয়া জেলা হাসপাতালে প্রতিদিন মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য খতিয়ে দেখতে মৃত্যু পর্যালোচনা বোর্ড ও মৃত্যু নিরীক্ষা কমিটি রয়েছে। সাত সদস্যের এ কমিটি ৬ জুলাই মৃত্যু কমাতে তিনটি সুপারিশ করেছিল। ১. আইসিইউ ও এইচডিইউ বাড়ানো, ২. অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানো এবং ৩. চিকিৎসক ও কর্মী বাড়ানো।
বাস্তবতা হলো, গত বছর আগস্টে হাসপাতালটিতে চারটি আইসিইউ শয্যা পাঠানো হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম ছাড়া। ফলে শয্যাগুলো চালু করা যায়নি। কুষ্টিয়ায় গতকাল মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের—কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ মা; কেউ স্বামী, কেউ স্ত্রী। গত বছর ১৮ মার্চ থেকে করোনায় এমন ১৭ হাজার ২৭৮ জনের মৃত্যু দেখেছে দেশের মানুষ।
হাসপাতালে চিকিৎসা বহু পরিবারকে আর্থিক সংকটেও ফেলছে। কারণ, সরকারি হাসপাতালেও তাদের ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ফরিদপুর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শহরের শ্রীঅঙ্গন মহল্লার মালতী রানী দাস (৫৫) ও তাঁর স্বামী সুবল চন্দ্র দাস (৫৮)। সুবল চন্দ্র বলেন, ‘এক দিনে ১০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। এত টাকা আমরা কই পাই।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।]