সুবহে সাদিকের প্রাক্কালে এই লেখা যখন লিখছি, চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহর থেকে, পুবের আকাশে আলো মিটিমিটি খেলছে। ইদানীং আকাশটা বেশ ঝকঝকে দেখা যায়। করোনার প্রভাবে গত দুই মাসে বায়ুদূষণ অবিশ্বাস্য হারে কমেছে, তাই আকাশটা খুব পরিষ্কার থাকে, তারাদের আনাগোনা সুন্দর করে উপভোগ করা যায়।
দুই মাস হতে চলল প্রায় অবরুদ্ধ জীবন। ইদানীং লিখতেও ইচ্ছা করে না। দেশের খবরাখবর দেখে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়। তাই আবারও কি-বোর্ডে আঙুল ঘোরানো। চীনের আকাশ থেকে এখন করোনা-মেঘের ছোবল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন হাজারো। একের পর এক দেশ লকড-ডাউন হচ্ছে। যারা এত দিন চীনকে নিয়ে উপহাস করেছে, আজ তাদের হাঁসফাঁস চোখে তিরের মতো বিঁধে!
মায়ের কাছে ডিজিটাল ফোন ছিল না। করোনা আউটব্রেকের পর আমার সঙ্গে সারা দিন কথা বলার জন্য মা একটা ডিজিটাল ফোন কিনেছে, দিনে এখন অসংখ্যবার আমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। আমাকে অনেকবার বলেও দেশে নিয়ে যেতে পারেনি বলে তার কত দুঃখ! তাকে আশ্বস্ত করতেই আমার দিন যেত—আমি ভালো আছি, নিরাপদে আছি। তারপরও সারা দিন স্বজন ও প্রিয়জনদের আমাকে নিয়ে কত উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা!
এখন সময়ের স্রোত আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে, মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আমার ঘুম হয় না। মা সবচেয়ে ভারনারেবল-এইজ গ্রুপে, সঙ্গে ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ আরও নানা রোগ। মাকে সবার থেকে দূরে থাকতে বলি। আমার মায়ের মতো লাখো কোটি মায়েরা এখন জীবন নিয়ে হুমকিতে। লাখো কোটি বাবা জীবন নিয়ে হুমকিতে। সে সময় আমরা আতশবাজি ফোটাতে ভীষণ ব্যস্ত। হঠাৎ পাওয়া স্কুল ছুটি উদযাপন করতে কক্সবাজার ভিড় করতে ব্যস্ত।
করোনার মাহামারির কাছে ইতিমধ্যে বিশ্বের সব সুপার পাওয়ার কুপোকাত! সরকারপ্রধানেরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার খুব একটা করতে না চাইলেও অবস্থা বেগতিক—তা বুঝতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কট্টরপন্থীদেরও বাধ্য হতে হয়েছে। সারা বিশ্বে হাহাকার চলছে ভেন্টিলেটরের জন্য। করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার এটাই যে শেষ এবং প্রধান হাতিয়ার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান প্রতিদিন বলে যাচ্ছেন টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। এমন সময়েও আমরা ব্যস্ত কে বিদেশ থেকে এল কে কোয়ারেন্টিনে থাকল, তা নিয়ে! সরকার কোটি কোটি টাকা দেদার খরচ করতে পারে, কিন্তু করোনা টেস্ট কিট কিনে আনতে পারে না। সারা দেশে শুধু একটি জায়গায় টেস্ট করা যায়—এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে কি না, আমার জানা নেই।
মানুষের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। এখন বাঁচার একমাত্র রাস্তা হলো, লকড-ডাউন—সারা দেশে মাস কোয়ারেন্টিন কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য। এরপর সাসপেকটেড সবাইকে টেস্ট করে আইসোলেশন। যেখানে উন্নত বিশ্বের সুপার পাওয়াররা থামাতে পারেনি, আমরা তাদের তুলনায় কী, সেটা সরকার মশাই ভালো জানে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং সরকার দয়া করে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশের মানুষের জীবন বাঁচান। আতঙ্কের কিছু নেই বলে বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখন কিছু করার থাকবে না।
চীন, ইরান, ইতালি কিংবা যুক্তরাষ্ট্র—তাদের দেখেও যদিও আমরা (সরকারসহ) কিছু না শিখি বা আন্দাজ না করি, তাহলে বলতেই হয় আমরা অন্ধ! কিন্তু অন্ধ থাকলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না। করোনা চুপিচুপি ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। দয়া করে চোখ খুলে (সরকারের প্রতি আহ্বান) আমাদের একটু বাঁচান। আর কত দিন এভাবে আমরা থাকব?
*লেখক: এমডি নিউরোলজি (অধ্যয়নরত), ইয়াংজো ইউনিভার্সিটি, জিয়াংসু, চীন