শিশুদের করোনার টিকা নিতে হবে যে কারণে
শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। তারপরও দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে তাদের করোনার টিকা দেওয়া উচিত।
এত দিন তো ১২ বছরের বেশি বয়স হলে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হতো। এখন পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদেরও টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই দেশে শিশুদের টিকা দেওয়া শুরু হবে। যুক্তরাষ্ট্র তো গত বছরের নভেম্বর থেকেই ৫ থেকে ১১ বছর বয়সের শিশুদের টিকা দিচ্ছে। এরপর কানাডাসহ অন্যান্য দেশেও শিশুদের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। শিশুদের টিকায় বেশ সুফল পাওয়া গেছে। অন্তত কোভিডে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তাই বলা যায়, বাংলাদেশেও আমরা শিশুদের টিকার ব্যবস্থা করলে এর সুফল
পাওয়া যাবে।
শিশুদের টিকার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় টিকাবিশেষজ্ঞ ডা. তাজুল ইসলাম এ বারির সঙ্গে। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আগে তো শুনেছি শিশুদের টিকার প্রয়োজন নেই। এখন কেন টিকার দরকার পড়ল। তিনি বললেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি। তাদের টি-সেল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। টি-সেল হলো রক্তের একধরনের শ্বেতকণিকা, যা দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অংশ।
টি-সেল দেহের অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন হয়ে থাইমাস গ্রন্থিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। শিশুদের থাইমাস গ্রন্থি খুব সক্রিয়। যেহেতু শিশুরা দ্রুত টি-সেল উৎপাদন করতে পারে, তাই শিশুদের সংক্রমিত করার আগেই দ্রুত ভাইরাস ধ্বংস করা সম্ভব হয়। এ জন্য শিশুদের কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। আক্রান্ত হলেও উপসর্গ প্রায় থাকেই না বা কিছু উপসর্গ দেখা দিলেও তা সর্দি-কাশি, সামান্য জ্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
শিশুদের ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের অসুস্থতাকে মাল্টিসিস্টেমস ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম বলা হয়। শিশুদের যেন এ ধরনের ক্ষতিকর অসুস্থতা না হয়, সেটি দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই শিশুদেরও টিকা দেওয়া দরকার।ডা. তাজুল ইসলাম এ বারি, টিকাবিশেষজ্ঞ
ডা. তাজুল ইসলাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। করোনাভাইরাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর স্পাইক প্রোটিন। এটি একধরনের আঁকশির মতো ছড়ানো থাকে। অন্যদিকে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের দেহকোষের বাইরের আবরণে এসিই-২ রিসেপ্টর থাকে।
করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন দেহকোষের এসিই-২ রিসেপ্টরগুলো আঁকড়ে ধরে কোষের ভেতর ঢুকে দেহকোষের অনুলিপি তৈরির স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিনতাই করে তার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর ভাইরাস অনায়াসে তার বংশবিস্তার করতে থাকে। তখনই আমরা কোভিডে আক্রান্ত হই। কিন্তু সেই এসিই-২ রিসেপ্টর না থাকলে করোনাভাইরাস দেহকোষের ভেতরে ঢুকতে পারে না এবং দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
ফুসফুসে শিশুদের এসিই-২ রিসেপ্টর থাকে কম
বাস্তবতা হচ্ছে শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের নিচের দিকে, বিশেষত ফুসফুস ও এর ঠিক ওপরের দিকের শ্বাসনালির কোষে (সেল) এই এসিই-২ রিসেপ্টর প্রায় থাকেই না। তাই শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তবে শ্বাসতন্ত্রের ওপরের ভাগে, বিশেষত তাদের নাক, মুখ, গলায় এই এসিই-২ রিসেপ্টর মোটামুটি থাকে। তাই শিশুদের সংক্রমণ সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের ভাগেই কিছুটা হয়। তবে ফুসফুস পর্যন্ত যেতে পারে না। কারণ, সেখানে তো এসিই-২ রিসেপ্টর থাকেই না।
সায়েন্স ম্যাগাজিনে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গবেষকেরা বলেছেন, মাত্র ৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এ ধরনের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা আছে। শিশুদের অবস্থা ঠিক বিপরীত। তাদের ৪৩ শতাংশ রোগ প্রতিরোধী।
টিকা কেন লাগবে
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এমন যদি হয়ে থাকে, তাহলে এখন কেন শিশুদের টিকা দরকার?
এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ডা. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোভিডের আদি ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল খুব মারাত্মক, কিন্তু দ্রুত ছড়াতে পারত না। আর কোভিডের বর্তমান বিভিন্ন ধরন বা উপধরন (ভেরিয়েন্ট ও সাব–ভেরিয়েন্ট), বিশেষত বিএ.৪, বিএ.৫ ও বিএ ২.৭৫ সাব–ভেরিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। অবশ্য এসব ধরনের সংক্রমণের তীব্রতা কম। এ জন্য আজকাল শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা, কোভিডে আক্রান্ত হলেও এটি শিশুদের মধ্যে সাধারণত সর্দি-কাশি-সামান্য জ্বরে সীমাবদ্ধ থাকে।
যেহেতু এটি কোভিড, তীব্র উপসর্গ না থাকলেও এর জের হয়তো চলতে থাকবে। এর ফলে শিশুদের ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের অসুস্থতাকে মাল্টিসিস্টেমস ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম বলা হয়। শিশুদের যেন এ ধরনের ক্ষতিকর অসুস্থতা না হয়, সেটি দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই শিশুদেরও টিকা দেওয়া দরকার, যেন ওরা কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্ষতির শিকার না হয়। পাশাপাশি এটিও মনে রাখতে হবে, মৃদু ও উপসর্গবিহীন শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
মনে রাখতে হবে সাতটি বিষয়
টিকাবিশেষজ্ঞ ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, শিশুদের টিকার ক্ষেত্রে সাতটি বিষয় মনে রাখা দরকার।
প্রথমত, গবেষণায় দেখা গেছে, এ টিকা শিশুদের জন্য নিরাপদ। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) জানিয়েছে, এ টিকা ছয় মাসের বেশি বয়সের শিশুর জন্যও নিরাপদ। পাঁচ বছরের বেশি বয়সের শিশুরা বুস্টার ডোজও নিতে পারবে। তবে কোনো শিশুর অ্যালার্জি থাকলে, তাদের টিকা গ্রহণের আগে চিকিৎসককে বিষয়টি জানাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এ টিকা শিশুদের কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে অনেকাংশে সহায়তা করে।
তৃতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুদের টিকার ডোজের মাত্রা বয়স অনুপাতে বেশ কম। এর ফলে টিকার কারণে সমস্যা তেমন হয় না।
চতুর্থত, টিকা গ্রহণের পর কারও কারও সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে সেটি এতই সামান্য যে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
পঞ্চমত, ইতিমধ্যে কারও কোভিড হয়ে থাকলে, করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ার অথবা করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসার তিন মাস পর টিকা
নেওয়া যাবে।
ষষ্ঠত, শিশুর প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার নির্ধারিত সময়ের পর দ্বিতীয় ডোজ এবং এরপর বুস্টার ডোজ নেওয়া যাবে।
সপ্তমত, কোনো শিশুর নিয়মিত অন্য কোনো টিকা নেওয়ার জরুরি প্রয়োজন থাকলে, সে একই সঙ্গে কোভিড–১৯ টিকাও নিতে পারবে।
শিশুদের টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এ কয়টি বিষয় মনে রাখতে পারি।
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো এবং মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক