সরকারের কাছে মজুত থাকা করোনার প্রায় এক কোটি ডোজ টিকার মেয়াদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। টিকা নিতে আগ্রহী লোক না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব টিকা দিতে পারেনি। টিকাগুলো চীনের সিনোভ্যাকের তৈরি।
সিনোভ্যাকের আরও প্রায় এক কোটি টিকা সরকার এখন গ্রহণ করতে চাইছে না। টিকাদানের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে কেনা এসব টিকা গ্রহণ না করলে অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কোভ্যাক্সের আওতায় কেনা সিনোভ্যাকের টিকার দাম পড়েছে সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে ২ কোটি টিকার দাম পড়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ১ কোটি ১০ লাখ টিকা গ্রহণ করতে না চাওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে। তবে মজুত থাকা টিকার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি জানেন না।
মজুত থাকা এক কোটি টিকার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানা যায় গত ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত করোনার টিকাদানসংক্রান্ত এক সভার কার্যবিবরণী থেকে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সভায় উপস্থাপিত তথ্য বলছে, তখন মজুত থাকা টিকার মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৮৮টি ছিল সিনোভ্যাকের, যার মেয়াদোত্তীর্ণের সময় ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ৩০ নভেম্বর। সভায় টিকাগুলো চীনের কাছে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এই যোগাযোগ হয়েছিল কি না, তা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শতে৴ প্রথম আলোকে বলেন, যে টিকা বাংলাদেশে চলে এসেছে, তা নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই।
সূত্র জানায়, সিনোভ্যাকের টিকাগুলো সরকার এখন তৃতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব মো. শামসুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সিনোভ্যাক টিকা তৃতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন এই টিকাগুলো কাজে লাগানো হবে।
অবশ্য এক কোটি টিকা কম সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, টিকা নিতে মানুষের আগ্রহ খুবই কম। ওদিকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগও নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, গত রোববার পর্যন্ত দেশের প্রায় ১২ কোটি ১৩ লাখ মানুষ করোনার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। ৯০ লাখের মতো মানুষ শুধু এক ডোজ টিকা নিয়েছেন।
করোনার টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নিয়েছেন প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ মানুষ। গত রোববারের হিসাবে, আগের ২৪ ঘণ্টায় তৃতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন দেড় লাখের মতো নারী-পুরুষ।
এক কোটি টিকা নিচ্ছে না বাংলাদেশ
কোভ্যাক্স থেকে সিনোভ্যাকের যে সাড়ে ৭ কোটি টিকা নেওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ টিকা এখনো দেশে আসেনি। সরকার ওই টিকা নিতে চায় না, তা তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব শামসুল হক বলেন, ওই টিকা নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, কোভ্যাক্সের একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে কোভ্যাক্সের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১ কোটি ১০ লাখ টিকা না নিলেও টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের যে সিনোভ্যাকের টিকা পাওয়ার কথা ছিল, তা থেকে ১০ লাখ ডোজ মিয়ানমারকে উপহার হিসেবে দিয়েছে সরকার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের মাধ্যমে এই উপহার দেওয়া হয়। গত ২৪ আগস্ট আসিয়ানের পক্ষ থেকে কম্বোডিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে মিয়ানমারকে টিকা অনুদানের জন্য ধন্যবাদ জানান।
টিকা এসেছে ৩২ কোটি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রধানদের নিয়ে গঠিত কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে টিকাদানে এগিয়ে আছে। এ দেশের ৭১ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। ভারতে হারটি প্রায় ৬৭ শতাংশ, পাকিস্তানে প্রায় ৫৭ শতাংশ ও নেপালে প্রায় ৭০ শতাংশ। মিয়ানমারের ৫১ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত মাসে জাতীয় সংসদে জানান, দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৩২ কোটি ৩১ লাখ টিকা আমদানি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া থাকলে সিনোভ্যাকের টিকা তৃতীয় ডোজ হিসেবে দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন আছে। মুশতাক হাসান বলেন, একসময় টিকার সংকট ছিল। তখন টিকা পাওয়া একটা বড় বিষয় ছিল। এখন টিকার সংকট নেই।