খুলনার চারটি হাসপাতালে কয়েক দিন ধরে ১৫ জনের বেশি করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ওই চারটি হাসপাতালে মারা গেছেন ২১ জন। খুলনায় এটিই করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
জেলার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যবিধির কোনো রকম তোয়াক্কা না করাকে দুষছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগ
আছে, খুলনায় শুরু থেকেই শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের চিহ্নিত করার কাজগুলো ঠিকমতো হয়নি। সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টিন করার কাজ মাঝেমধ্যে হয়েছে। তবে বেশির ভাগ সময় তা ঠিকমতো হয়নি।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আর মৃত্যুর প্রথম খবর আসে ২১ এপ্রিল। এরপর ১৫ মাস কেটে গেছে। কিন্তু জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। করোনা প্রতিরোধ কমিটিগুলো নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। তবে বেশির ভাগ কাজই হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। আর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে খুলনার মানুষের মধ্যে উদাসীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছরের শুরুর দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, মানুষকে হাত ধোয়ায় উৎসাহিত করতে বিভিন্ন জায়গায় সাবানপানির ব্যবস্থা, বিপণিবিতানগুলোতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল। ধীরে ধীরে তা উঠেই গেছে। শনাক্ত হওয়া রোগীদের আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ আর উপজেলা প্রশাসন কাজ করেছে। তবে সবক্ষেত্রে তা ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। বুধবার পর্যন্ত হাসপাতাল ও বাসায় মিলিয়ে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন ১০৪ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, গতকাল বুধবার জেলায় ৫৮৫ জনের করোনা শনাক্ত হয় আর ওই দিন হাসপাতালে মারা গেছেন ২১ জন। শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। গতকাল পর্যন্ত জেলায় করোনায় ৩১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভাগীয় শহর হওয়ায় হাসপাতালের ওপর চাপ অনেক বেশি। খুলনার তিনটি সরকারি হাসপাতালে (খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতাল, ২৫০ শয্যার খুলনা জেনারেল হাসপাতাল) করোনা রোগীদের জন্য ২৪৫টি সাধারণ শয্যা আছে। খুব কমসংখ্যক করোনা রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এখনো। সরকারি সব কটি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা আছে। ৭৪টির মতো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে।
খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ সময় মানুষ সেই পদক্ষেপে শামিল হতে চায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মানলে অবস্থা এত খারাপের দিকে যেত না। সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া কারও একার পক্ষে এই যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়।
জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময় লকডাউনের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কম করে হলেও চার দফায় বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে খুলনায়। তবে বিধিনিষেধের তেমন কোনো সুফল মেলেনি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এসব বিধিনিষেধ ও লকডাউন চলাকালে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে।
খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, মাস্ক পরার ক্ষেত্রে অনীহা আছে। অনেকে আবার যথাযথভাবে পরেও না। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। মানবিক সহায়তায় কয়েক দফায় খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ১ লাখ ৭৮ হাজার পরিবারকে ঈদের আগে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। খাবারের কোনো সমস্যা থাকবে না।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি (খুলনা) শেখ বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শুরু থেকেই পদ্ধতিগত অনেক ভুল ছিল। করোনা সংক্রমণের উৎস নির্ধারণ করা হয়নি। কারা ছড়াচ্ছে, কোন জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ—সেসব শনাক্ত করা হয়নি। খুলনার জনসংখ্যা আর রোগের বিস্তৃতি অনুসারে আসলে কোভিডের জন্য কত শয্যা দরকার, কত সরঞ্জাম দরকার, সেটা সঠিকভাবে পরিকল্পনামাফিক নির্ধারণ করা হয়নি। প্রয়োজন নির্ধারণ না করেই মনগড়া কিছু করা হয়েছে। মোট কথা, প্রতিরোধে ব্যবস্থা জোরদার ছিল না, চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপকরণ, অবকাঠামো, জনবল ঘাটতি ছিল এবং এখনো আছে।