নানা জটিলতা ও অস্পষ্টতার মধ্যে যেভাবে টিকা পেলেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী
এক টিকাকেন্দ্র থেকে আরেক টিকা কেন্দ্রে—দুই দিনে চারবার ঘুরেও টিকা নিতে ব্যর্থ হন অন্তঃসত্ত্বা এক নারী (২৭)। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় দিন অন্তঃসত্ত্বার তথ্য গোপন করে তিনি সহজে টিকা নিতে পেরেছেন।
ওই নারীর ঘটনাটি ধরে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনা প্রচারের অভাবে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কোথায় কীভাবে টিকা নিতে হবে, সে সম্পর্কে এখনো চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্পষ্ট ধারণা নেই। কোনো কোনো সেবা প্রতিষ্ঠান অন্তঃসত্ত্বা নারীর কাছে সম্মতিপত্র চাইছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ থাকলেই টিকা দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকা না দিয়ে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী জানেন না, মুঠোফোনে বার্তা না এলেও তিনি টিকা দিতে পারবেন। কত অন্তঃসত্ত্বা নারী টিকা নিচ্ছেন, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো তথ্যও রাখছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া শুরু হয়। গত ২ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গঠিত জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটি (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ) সুপারিশ দেওয়ার পর অন্তঃসত্ত্বা নারী ও সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো মায়েদের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়।
যেভাবে টিকা পেলেন ওই নারী
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ওই নারী ৩১ সপ্তাহের (প্রায় আট মাস) অন্তঃসত্ত্বা। এটা তাঁর প্রথম গর্ভধারণ। স্বামী একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।
এক সপ্তাহ আগে গত বুধবার ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড টিকা দেওয়া না থাকলে কোনো কোনো হাসপাতালে প্রসবের জন্য ভর্তি নেওয়া হয় না। চিকিৎসক তাঁকে বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন আট মাস পূর্ণ হওয়া ও ধনুষ্টংকার রোধে টিটি টিকা নেওয়ার আগে যেন তিনি কোভিড টিকা নিয়ে নেন। আগস্ট মাসে টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করলেও বার্তা পাচ্ছিলেন না। পরে ১৫ সেপ্টেম্বর সরাসরি চলে যান কেন্দ্র উত্তর সিটি করপোরেশন পরিচালিত নগর মাতৃসদনে (আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট-২)। স্বেচ্ছাসেবকেরা জানান, বার্তা ছাড়াও টিকা নিতে পারবেন এবং সিস্টেম থেকে তাঁর মুঠোফোনে বার্তা পাঠানো হয়। পরে কেন্দ্রের চিকিৎসক জানান, তাঁদের কাছে সম্মতি ফরম নেই, তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকা দেন না। তাঁদের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যেতে বলেন। পরদিন তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গেলে বলা হয়, অন্য কেন্দ্র থেকে আসা কাউকে তারা টিকে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরে তিনি মাতৃসদনে ফেরত গেলে তাঁকে ১৯ সেপ্টেম্বর দেখা করতে বলা হয়।
ওই নারী বলেন, ‘আমি ওই দিন গিয়ে আর অন্তঃসত্ত্বা বলে জানাইনি। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিয়ে চলে এসেছি। মাস্ক ও বড় ওড়না দিয়ে মুখ-গা ঢেকে রাখায় কেউ বুঝতে পারেননি যে আমি অন্তঃসত্ত্বা।’
আমি ওই দিন গিয়ে আর অন্তঃসত্ত্বা বলে জানাইনি। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিয়ে চলে এসেছি। মাস্ক ও বড় ওড়না দিয়ে মুখ-গা ঢেকে রাখায় কেউ বুঝতে পারেননি যে আমি অন্তঃসত্ত্বা।
ওই কেন্দ্রের ক্লিনিক ব্যবস্থাপক চিকিৎসক লাবিবা সাফিনাজ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সেবাকেন্দ্রে সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো মাকে টিকা দেওয়া হলেও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে টিকা দেওয়া হয় না। এর আগে কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তাঁরা প্রত্যয়নপত্র দিয়ে অন্য সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
রাজধানীর পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা উদ্যোক্তা মাসুমা খাতুন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি প্রথম আলোকে জানান, আগস্ট মাসে তিনি অনলাইন ফরম পূরণ করলেও এখনো বার্তা পাননি। বার্তা ছাড়াই যে তিনি টিকা পেতে পারেন, তা তিনি জানেন না।
একেক সেবা প্রতিষ্ঠানে একেক ব্যবস্থা
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর-১–এর লালকুঠীতে অবস্থিত ‘মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ এবং ২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতাল’–এ গিয়ে দেখা যায়, দুটি বুথে নারী-পুরুষ কোভিড-১৯ টিকা নিচ্ছেন। ওই দিন প্রায় ৪০০ ব্যক্তি টিকা নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন দুজন। হাসপাতালের উপপরিচালক মোরশেদা খানম প্রথম আলোকে বলেন, শুধু চিকিৎসকের উপদেশপত্র দেখালেই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তাঁরা টিকা দিচ্ছেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ২৫ হাজার ৯৪৬ জন। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তথ্য আলাদাভাবে রাখা হয় না। আনুমানিক ১৫-২০ জন টিকা নিয়েছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ৫৩ হাজার ১৯৪ জন। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারী ৩২ জন এবং সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো মা ২৩ জন।
হাসপাতালের পরিচালক মো. মুনীরুজ্জামান সিদ্দীকী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অন্তঃসত্ত্বা নারীর কাছে চিকিৎসকের উপদেশপত্র দেখতে চান। এরপর হাসপাতালের চিকিৎসকের মাধ্যমে নির্ধারিত সম্মতিপত্রে অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাক্ষর নেন যে ‘তিনি জেনে বুঝে টিকা নিচ্ছেন’।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচালিত ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে গর্ভধারণের ১৩ থেকে ৩৩ সপ্তাহের মধ্যের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে শুধু চিকিৎসকের উপদেশপত্র থাকলেই টিকা দেওয়া হয়।
এর আগে গণটিকা কার্যক্রমের সময় ৮ আগস্ট রাজধানীর কালাচাঁদপুর সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ টিকাদান কেন্দ্রে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিকাদানকারী হোসনেয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় সরকারের ঘোষণা থাকলেও তাঁদের কাছে কোনো লিখিত নির্দেশনা ছিল না।
বুশরা আয়েশা নামে ৩০ সপ্তাহের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রথম আলোকে জানান, তাঁর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্ট থাকায় চিকিৎসক কোভিড টিকা নিতে নিষেধ করেছেন।
কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য রাখা জরুরি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, আগে ফরমে দেওয়া ছিল ‘আপনি কি গর্ভবতী?’ সেটাতে চাপ দিলে ফরম পূরণ করা যেত না। জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটির সুপারিশের পর অনলাইন নিবন্ধন ফরম অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা নারী বার্তা না এলেও টিকা নিতে পারবেন। তাঁকে চিকিৎসকের উপদেশপত্র দেখাতে হবে। কেন্দ্রের একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে সম্মতিপত্রে তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হবে। সম্মতিপত্র অনলাইনে রয়েছে। কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ তা প্রিন্ট করে নেবে। ওই কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তথ্য রাখা হয়নি।
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকার তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে রাখা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তথ্য রাখা হলে বোঝা যাবে, কতজন অন্তঃসত্ত্বা নারী টিকা নিচ্ছেন। কারও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, তা শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তিনি বলেন, গর্ভধারণের যেকোনো অবস্থায় টিকা নেওয়া যাবে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে, এমন অন্তঃসত্ত্বা নারীদের দ্রুত টিকা নেওয়া উচিত। কারণ, তাঁরা কোভিডের ঝুঁকিতে রয়েছেন। শ্বাসকষ্ট রয়েছে, এমন অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকার ক্ষেত্রে তাঁকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন, এমন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।