ডিসেম্বরের মধ্যে আসবে উপহারের ৬ কোটি টিকা
টিকার বড় উৎস হয়ে উঠছে কোভ্যাক্স। বৈশ্বিক এই উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশ বিনা মূল্যে টিকা পাচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য করোনার টিকার বড় উৎস হয়ে উঠছে বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স। এ উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ছয় কোটি ডোজ করোনার টিকা পেতে যাচ্ছে। এ টিকা বাংলাদেশকে কিনতে হবে না, পাওয়া যাবে বিনা মূল্যে। তবে কোন মাসে কত টিকা আসবে, তার কোনো পথনকশা আগেভাগে জানায় না কোভ্যাক্স।
কোভ্যাক্সের আওতায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৮৯ লাখ টিকা পেয়েছে। সর্বশেষ চালান হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার কোভ্যাক্সের মাধ্যমে চীন থেকে ১৭ লাখ সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে এসেছে।
বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সমভাবে করোনার টিকা বণ্টন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০২০ সালের এপ্রিলে কোভ্যাক্স গঠিত হয়। এ পর্যন্ত ১৬৫টি দেশ কোভ্যাক্সের সদস্য হয়েছে। উন্নত দেশ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, ব্যক্তি ও ফাউন্ডেশনের অনুদানে টিকা সংগ্রহ করে কোভ্যাক্স।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মো. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভ্যাক্স বাংলাদেশকে কী পরিমাণ টিকা দেবে, তা আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ছয় কোটি ডোজ টিকা পাব।’ তিনি বলেন, এই ছয় কোটি ডোজ পাওয়া যাবে বিনা মূল্যে। এরপরে কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা চাইলে কিনতে হবে।
ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের সামনে এখন টিকার উৎস তিনটি।
১. চীনের কাছ থেকে কেনা। ২. কোভ্যাক্সের মাধ্যমে পাওয়া ও ৩. রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা।
চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের আলোচনাও চলছে। চীন থেকে মোট সাড়ে সাত কোটি টিকা আনা হবে বলে সরকারের দুজন মন্ত্রী গত সপ্তাহে জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
টিকার সরবরাহ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে এ কারণে যে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত সোমবারের হিসাবে, সরকারের সুরক্ষা অ্যাপে টিকার জন্য নিবন্ধন করে অপেক্ষায় ছিলেন ১ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। প্রায় ২ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ ওই দিন পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেন। গতকাল রাতে সংখ্যাটি বেড়ে ২ কোটি ৮৭ লাখে উন্নীত হয়। এর মানে হলো, এক দিনেই ১৯ লাখ মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন।
বিপরীতে করোনার টিকার মজুত এখন কিছুটা কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারের হাতে গতকাল ৬৪ লাখের মতো টিকা ছিল। এর পর আসে কোভাক্সের মাধ্যমে চীনের পাঠানো ১৭ লাখ টিকা। হাতে মজুত কমে যাওয়ার দেশে গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত তিন দিনে প্রায় ৪৪ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর আগে দিনে দেওয়া হতো মোটামুটি তিন লাখ করে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অংশ হিসেবে সাধারণ টিকাদান কেন্দ্রের বাইরে গত শনিবার থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়া হচ্ছে। আর সিটি করপোরেশন এলাকায় আগে থেকে নিবন্ধন না করা মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এতেই টিকাদান বেড়ে গেছে। নিবন্ধন ছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ ইউনিয়ন, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রে ভিড় করছেন। সবার উদ্দেশ্য টিকা নেওয়া। টিকা নিতে মধ্যরাত থেকে লাইনে দাঁড়ানো, বচসা-হাতাহাতি, তদবির ও ঘুষ দেওয়ার খবরও আসছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকাকেন্দ্রের বাইরে গতকাল ভোরে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য। তাঁদের একজন ফারজানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের দুই দিন ফজরের নামাজ পড়েই লাইনে দাঁড়াতে আসি। কিন্তু শতাধিক মানুষের পেছনে পড়ে যাই। তাই এবার মধ্যরাতেই দাঁড়িয়েছি।’
এ মাসেই আসছে কোটি টিকা
বাংলাদেশ গত ২১ জানুয়ারি থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৪ হাজার টিকা পেয়েছে। এরপর গতকাল আসে ১৭ লাখ টিকা। এটিসহ চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রায় এক কোটি টিকা পাবে বলে মোটামুটি নিশ্চিত।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোভ্যাক্সের মাধ্যমে চীনের দেওয়া আরও ১৭ লাখ টিকা এ মাসেই আসবে। সিনোফার্মের কাছ থেকে কেনা অন্তত ৫০ লাখ টিকা এ মাসে পাবে বাংলাদেশ। জাপানের উপহার দেওয়া অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৩ লাখ ৫৭ হাজার টিকাও এ মাসে আসবে।
কোভ্যাক্সের আওতায় কোন টিকা
কোভ্যাক্স থেকে কোন টিকা আসবে জানতে চাইলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোভ্যাক্স তাদের তহবিলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১০ লাখ টিকা সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে পাঠাবে। বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা ফাইজারের (যুক্তরাষ্ট্রের) ৬০ লাখ টিকা পাঠানোর প্রস্তুতিও নিয়েছে কোভ্যাক্স। এই টিকা সংরক্ষণের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর তা পাঠানো হবে।
ফাইজারের টিকা অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশে ফাইজারের টিকা জন্য সংরক্ষণব্যবস্থা তৈরিতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে গত রাতে কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করেছি একসঙ্গে সব ফাইজারের টিকা না পাঠাতে। ধাপে ধাপে পাঠালে সংরক্ষণে আমাদের সুবিধা হবে। এই মুহূর্তে ৬০ লাখের অর্ধেক পরিমাণ ফাইজারের টিকা রাখার সক্ষমতা আমাদের আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ফ্রিজার কিনছি। যেকোনো সময় তা দেশে আসবে।’
দরিদ্র দেশগুলোতে টিকাদান নিশ্চিতের বৈশ্বিক জোট গ্যাভির ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোভ্যাক্স ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৯০ কোটি টিকা বিতরণ করতে চায়। জেনেভার কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা না পেয়ে কোভ্যাক্স বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহে জোর দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মাসে গ্যাভি চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকা কেনার জন্য আগাম ক্রয় চুক্তি করে।
গ্যাভির ওয়েবসাইটে তুলে ধরা এক বক্তব্যে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেথ বার্কলে বলেন, ‘চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির ফলে কোভ্যাক্সের অংশীদারেরা খুব শিগগির টিকা হাতে পাবেন।’
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, কোভ্যাক্স এখন পর্যন্ত অন্তত ১১টি টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোফার্মের টিকা পেয়েছে। নোভোভ্যাক্স ও সিনোভ্যাকের টিকাও কোভ্যাক্সের আওতায় পাবে বাংলাদেশ।
মডার্নার প্রথম ডোজ বন্ধ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া এক নির্দেশনায় গতকাল জানানো হয়, আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। শুরু হবে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া। আগামী শনিবার থেকে সারা দেশে সিনোফার্মের দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু করতে হবে।
দেশে এখন পর্যন্ত ৫৫ লাখ মডার্নার টিকা এসেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের উপহার দেওয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত সোমবার পর্যন্ত মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ১৯ লাখের কিছু বেশি। আর সামান্য কিছু টিকা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
সাত দেশের মধ্যে পাঁচ নম্বরে
কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের ওয়েবসাইটে দেওয়া হিসাবে, করোনার দুই ডোজ টিকাদানে সার্কভুক্ত সাতটি দেশের মধ্যে এখন বাংলাদেশ পাঁচ নম্বরে রয়েছে। দেশে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৭৪ শতাংশকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে সবার ওপরে ভুটান, হার প্রায় ৬২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। ভারতে এ হার প্রায় ৮ শতাংশ। নেপাল প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দিয়েছে। বাংলাদেশের পেছনে থাকা পাকিস্তানে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর আফগানিস্তানে এ হার শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওয়েবসাইটে মালদ্বীপের হিসাবটি পাওয়া যায়নি।
সরকার দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে চায়। এ জন্য প্রয়োজন ২৬ কোটি টিকা।