টিকার সুযোগের বাইরে কোটি শিশু-কিশোর
সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা ষাটোর্ধ্ব মানুষের করোনার টিকার প্রয়োজন বেশি। এই বয়সীদের এক-তৃতীয়াংশ এখনো টিকার প্রথম ডোজ পাননি। ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা টিকা পেলেও একই বয়সী প্রায় ১ কোটি শিশু-কিশোর টিকা পাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদাহরণ করোনা টিকাদানে ন্যায্যতার ঘাটতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বৈশ্বিকভাবে করোনার টিকাদান শুরুর আগে থেকেই টিকাদানে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, টিকাদানে যেন কোনো বৈষম্য না হয়। টিকাদানে ন্যায্যতা নিশ্চিত না হলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
টিকার ক্ষেত্রে ন্যায্যতার অর্থ হচ্ছে যার প্রয়োজন সে টিকা পাবে। ব্যক্তির আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আবাসস্থল, বয়স, লিঙ্গ, জাতিসত্তা টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হবে না। জাতীয় করোনা টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় ন্যায্যতার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা টিকা পাচ্ছে। শিক্ষার বাইরে থাকা এই বয়সীদের জন্য সুযোগই নেই। টিকাদানে ন্যায্যতার ঘাটতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করা নিয়ে খুব উচ্চকিত ছিল, কিন্তু এই সুযোগ বহু মানুষ নিতে পারেননি। ষাটোর্ধ্ব বহু মানুষ এখনো প্রথম ডোজ টিকা পাননি, অথচ তৃতীয় ডোজ দেওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ রকম আরও উদাহরণ বলছে, করোনার টিকাদানে ন্যায্যতার ঘাটতি আছে।’
পাওয়ার কথা, কারা পেলেন না
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছিল, তিন শ্রেণির মানুষ টিকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে: যাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি, যেসব জনগোষ্ঠী থেকে সংক্রমণ ছাড়ানোর আশঙ্কা বেশি এবং আক্রান্ত হলে যাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এসব বিবেচনায় শুরুতে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ও সম্মুখসারির কর্মীসহ আরও কিছু জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যা ১ কোটি ৪১ লাখ ২৩ হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া আনুমানিক হিসাবে, এ পর্যন্ত এঁদের মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন ৯০ লাখ ২১ হাজার মানুষ। অর্থাৎ ষাটোর্ধ্ব ৫০ লাখ মানুষ এখনো কোনো টিকা পাননি।
দেশে এ পর্যন্ত করোনায় ২৮ হাজার ১২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ৫৫ শতাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। এই বয়সী মানুষ নানা ধরনের রোগে ভুগতে থাকেন, তাঁদের অনেকের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কম থাকে। ঝুঁকিতে থাকা এই বয়সী মানুষের এক-তৃতীয়াংশ এখনো টিকার এক ডোজও পাননি।
স্বাস্থ্য বিভাগ টিকাদানের সব ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে না। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের শিক্ষিত মানুষ তুলনামূলকভাবে টিকা বেশি পেয়েছেন। গ্রামের ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানুষ টিকা কম পেয়েছেন। এই পার্থক্য দূর করার জন্য প্রচার-প্রচারণা জোরদারসহ বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল।
এই পরিস্থিতিতে বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত পার্থক্য আরও বাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের একটি অংশ এখন নিয়মিতভাবে বুস্টার ডোজ দেওয়ায় ব্যস্ত। অথচ সারা দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ টিকার প্রথম ডোজই পায়নি।
বৈষম্য শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে
১ নভেম্বর থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া শুরু করে। প্রথমে ঢাকা শহরে দেওয়া হলেও এখন তা দেওয়া হচ্ছে ৬৪ জেলায়।
বিবিএসের তথ্য বলছে, ১২-১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোর আছে ২ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ১ কোটি ১৬ লাখের কিছু বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশের ২০ লাখের মতো ওই বয়সী শিক্ষার্থীকে এখনো টিকা দিতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। এই টিকা না পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো দোষ বা ভুল ছিল না। কিন্তু সরকার বলেছে, টিকা পায়নি এমন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারবে না। অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের অনেকেই বলেছেন, এটা অন্যায্য।
অন্যদিকে ১২-১৭ বছর বয়সী প্রায় ৯৪ লাখ শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না। এদের কিছু মাদ্রাসায় যায়, বেকার ঘুরে বেড়ায় বা কেউ কেউ শিশুশ্রমে জড়িত। এরা জানতে পারছে না—এরা টিকা পাবে, নাকি পাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাবিষয়ক কমিটির সদস্যসচিব শামসুল হক বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর একই বয়সীদের টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এদের সংগঠিত করা কঠিন।’