করোনা নিয়ে সরকারি তথ্যে নানা অসংগতি

করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না থাকলেও অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে তা দেখানো হচ্ছে।

ফাইল ছবি।

ভোলা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, জামালপুর—স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে এই পাঁচ জেলার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য ২০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে। বাস্তবে এসব হাসপাতালে গতকাল রোববার পর্যন্ত সচল কোনো আইসিইউ শয্যাই ছিল না।

আবার সিলেট জেলায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত চারটি সরকারি হাসপাতালে গতকাল চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ৪৩৬ জন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এই জেলায় গতকাল চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ১৩৬ জন।

শুধু এই দুটি নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনকার করোনাবিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে এমন নানা ধরনের তথ্যবিভ্রাট ও গরমিল থাকছে। কোনো জেলায় ভর্তি রোগীর তথ্য কম দেখানো হচ্ছে, আবার কোনো জেলায় হাসপাতালের শয্যা ও উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা যন্ত্র বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া আইসিইউ–সুবিধা না থাকলেও তা হিসাবে যুক্ত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মূলত জেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের তথ্য দিচ্ছে। প্রায় সব জেলাতেই করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ায় এখন উপজেলা হাসপাতালেও অনেক রোগী ভর্তি থাকছেন। পার্বত্য এলাকার উপজেলাগুলোর বাইরের মাত্র তিন–চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাধীন রোগীর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে যুক্ত করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের বিজ্ঞপ্তিতে দেশের ৯৬টি সরকারি হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা, ভর্তি রোগী, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্য থাকে। গতকাল প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা এসব হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

অধিদপ্তরের হিসাবে, এসব হাসপাতালে গতকাল শয্যা ছিল ১৩ হাজার ৭৯৮টি। প্রথম আলোর সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে শয্যা ১৩ হাজার ৪৬৫টি। অধিদপ্তরের হিসাবে, ৭৫০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৭৪টি গতকাল ফাঁকা ছিল। প্রথম আলোর সংগ্রহ করা তথ্য বলছে, ৭১৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ফাঁকা ছিল ২২টি।

সঠিক তথ্য প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি প্রশাসনে। প্রকৃত চিত্র না দেখানোর একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে কাজ করে। তথ্য আড়াল করা জনগণের জন্য খারাপ, সরকারের জন্যও খারাপ।
মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা, আইইডিসিআর

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মহামারি পরিস্থিতি মূল্যায়ন, প্রক্ষেপণ, নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সঠিক তথ্য দরকার। আস্থাহীন পরিবেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে না। এর ফলে মানুষ সরকারের ভালো উদ্যোগেও সাড়া দিতে দ্বিধা করতে পারে। লকডাউন বা যেকোনো উদ্যোগে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হলে সঠিক তথ্য দিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের শয্যার মিল না পাওয়ার বিষয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শয্যা ফাঁকা বা পূর্ণ থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দেওয়া। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানায়। আর যে তথ্য প্রতিদিন অধিদপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তা ২৪ ঘণ্টা আগের তথ্য।

আইসিইউ না থেকেও আছে ৬ হাসপাতালে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভোলা জেলায় করোনা রোগীদের জন্য ৬টি আইসিইউ চালু রয়েছে। কিন্তু ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে আইসিইউ শয্যা রয়েছে, কিন্তু কোনোটিই এখনো চালু করা যায়নি।

ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক সিরাজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি আইসিইউ আছে, এসব চালানোর মতো লোকবল নেই। হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও লোকবল ৫০ শয্যার কম।

করোনা রোগীদের চিকিৎসায় পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন মাস আগে পাঁচটি আইসিইউ শয্যা দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতালের একটি আইসিইউ ইউনিটও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু প্রশিক্ষিত জনবল আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় চালু করা যায়নি আইসিইউ সেবা। বাধ্য হয়ে গুরুতর রোগীদের ছুটতে হয় ৪০ কিলোমিটার দূরের বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) একটি করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। অধিদপ্তরের হিসাবে এই ইউনিটে ৩টি আইসিইউ রয়েছে। তবে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধিদপ্তর বলায়, একটি করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। কোনো আইসিইউ এই হাসপাতালে নেই।’

রোগী থাকলেও তালিকায় নাম নেই

সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৩২৫টি শয‌্যা রয়েছে। গতকাল এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৯৭ জন। এ ছাড়া শহরের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, ৩১ শয্যার খাদিমপাড়া হাসপাতাল এবং দক্ষিণ সুরমা ৩১ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও করোনা রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নাম নেই।

গাজীপুরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মেমোরিয়াল কেপিজে হাসপাতালে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে ১০০ শয্যার সক্ষমতা থাকলেও অক্সিজেন–স্বল্পতার জন্য গতকাল পর্যন্ত ৪২টি শয্যা চালু করা গেছে। এই হাসপাতালটিতে গতকাল ৪২টি শয্যার বাইরেও আরও ৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। তবে অধিদপ্তরের হাসপাতালের তালিকায় ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালের নাম নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনা রোগীদের জন্য ৩৫৫টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (প্রা.) করোনা রোগীদের জন্য ১০০ শয্যা রয়েছে বলে অধিদপ্তরের তথ্যে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ৩০টি।

উপজেলা পর্যায়ে ভর্তি রোগীর তথ্য নেই

বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত জেলা সদর বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে এখন অনেক রোগী ভর্তি। কিন্তু অধিদপ্তর শুধু জেলা বা মেডিকেল কলেজের তথ্য বিজ্ঞপ্তিতে যুক্ত করছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের নির্ধারিত করোনা হাসপাতাল ছাড়াও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সম্প্রতি ৬৬ শয্যা চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩০ শয্যার করোনা ওয়ার্ডে ১১ জন ও জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬ শয্যার করোনা ওয়ার্ডে ১০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী গতকাল ভর্তি ছিলেন।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে করোনা শয্যার সংখ্যা ২০০। সেখানে গতকাল ভর্তি ছিলেন ২৪৩ জন। জেলার দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮ জন, ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৯ জন, মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ জন, কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৫ জন এবং খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ জন ভর্তি ছিলেন গতকাল। সব মিলিয়ে কুষ্টিয়ায় গতকাল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৩১৮ জন রোগী। অথচ অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে ১৬৭ জন রোগী ভর্তির তথ্য রয়েছে।

শয্যা থাকলেও রোগী রাখার মতো না

রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) মিলিয়ে মোট শয্যা রয়েছে ৫০০টি। এর মধ্যে ৪৯২টি শয্যাতেই গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। অথচ এর বিপরীত চিত্র হাসপাতালটির সাধারণ শয্যা ক্ষেত্রে। হাসপাতালের ৫৫৪টি সাধারণ শয্যার মধ্যে প্রতিদিনই প্রায় ৫০০টি শয্যা খালি থাকছে। গতকাল শয্যা খালি দেখানো হয়েছে ৪৮২টি।

হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের যে শয্যাগুলো খালি আছে, সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ নেই। সার্বক্ষণিক অক্সিজেন লাগবে, এমন রোগীদের ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

রোগী ভর্তির মতো সুযোগ–সুবিধা, লোকবল না থাকলেও অধিদপ্তরের তথ্যে কয়েকটি হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত বলে দেখানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ৫৪ শয্যার চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল, রাজধানীর মহাখালীর ৫০ শয্যার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল এবং ফেনীর সোনাগাজীর মঙ্গলকান্দি ২০ শয্যা হাসপাতালের কথা বলা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে এসব হাসপাতালের বেশির ভাগ শয্যা খালি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জটিল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা ওই তিন হাসপাতালে নেই।

উপসর্গযুক্ত রোগীতে ভর্তি হাসপাতাল

করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে উপসর্গযুক্ত অনেক রোগী সেবা নিচ্ছেন। অনেক হাসপাতালে শনাক্ত রোগীর চেয়ে উপসর্গযুক্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। মানিকগঞ্জে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের শয্যা ১০০টি। গতকাল সেখানে ২৫১ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ৯৫ জন করোনা পজিটিভ এবং বাকি ১৫৬ জন উপসর্গযুক্ত রোগী।

নওগাঁ জেলায় করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত কোনো হাসপাতাল নেই। তবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ২০১টি শয্যা রয়েছে। এসব শয্যায় গতকাল ৪৫ জন করোনা পজিটিভ রোগী এবং উপসর্গ নিয়ে ১১৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক তথ্য প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি প্রশাসনে। প্রকৃত চিত্র না দেখানোর একটা প্রবণতা অনেকের মধ্যে কাজ করে। ব্যবহারের অযোগ্য আইসিইউ শয্যা সরকারি তালিকায় সচল হিসেবে দেখানোর কোনো যুক্তি নেই। কোথাও কোনো ঘাটতি থাকলে তা জানানো উচিত। এতে ঘাটতি দূর করা বা ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। তথ্য আড়াল করা জনগণের জন্য খারাপ, সরকারের জন্যও খারাপ।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা)