প্রজ্ঞাপনে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ রাখার দাবি

সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে ‘শারীরিক’ শব্দ নেই; কিন্তু প্রজ্ঞাপনে শব্দটি যোগ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংশোধনের প্রজ্ঞাপনে শুধু ‘শারীরিক’ প্রতিবন্ধী শব্দটি থাকায় অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবেন বলে মনে করছেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও আইনসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা দ্রুত প্রজ্ঞাপনে সংশোধনী এনে শারীরিক প্রতিবন্ধী শব্দ পাল্টে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ শব্দ যোগ করার কথা বলছেন।

গত মঙ্গলবার এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে’ কথাটি উল্লেখ করা আছে।

নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ (যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সব গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ। বাকি পদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে। তবে নির্ধারিত এই কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে কোটার শূন্য পদও সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।

কোটার সুবিধা পাওয়ার অধিকার সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আছে। কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।
সারা হোসেন, আইনজীবী

এর আগে গত রোববার সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন। এতে প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো বলে উল্লেখ আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল বুধবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রজ্ঞাপনে শারীরিক শব্দটি থাকলেও অন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবেন না। এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

সরকার ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন করেছে। এতে স্পষ্টভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায় প্রতিবন্ধিতার ধরন হিসেবে অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাক্‌প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা—এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, আইনটিতে কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে কোন ধরনের প্রতিবন্ধী বলা হবে, তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

আইনটিতে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, একটি বা উভয় হাত বা পা না থাকা, কোনো হাত বা পা পূর্ণ বা আংশিকভাবে অবশ অথবা গঠনগত এমন ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বল যে দৈনন্দিন সাধারণ কাজকর্ম বা সাধারণ চলন বা ব্যবহার ক্ষমতা আংশিক বা পূর্ণভাবে ব্যাহত হয় বা স্নায়বিক অসুবিধার কারণে স্থায়ীভাবে শারীরিক ভারসাম্য না থাকা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন ভিজ্যুয়ালি ইমপিয়ার্ড পিপলস সোসাইটির (ভিপস) সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন মজুমদার বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সে রায়ে ‘শারীরিক’ শব্দটি নেই; কিন্তু প্রজ্ঞাপনে শব্দটি যোগ করা হয়েছে। এতে ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী। অর্থাৎ দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ, যাঁদের অন্তত একধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ।

সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। প্রজ্ঞাপনে ‘শারীরিক’ শব্দটি যোগ করায় তিনিও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আগে চাকরির কোটায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে এতিম যোগ ছিল, ফলে এতিম প্রাধান্য পেতেন, প্রতিবন্ধীরা চাকরি পেতেন না। আর এবার হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি যোগ হওয়ায় খুব কমসংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চাকরি পাবেন।

আইনি সহায়তা দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোটার সুবিধা পাওয়ার অধিকার সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আছে। কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। দ্রুত প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা প্রয়োজন।