খালা থেকে আম্মু ছিলেন আগেই, এখন আম্মু থেকে তিনজনের ‘মা‌’ হলেন রুখসাত সুলতানা

বোনের তিন সন্তানকে মায়ের মমতা দিয়ে বড় করতে থাকা রুখসাত সুলতানা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মা হয়েছেন। আজ ওই তিন শিশুর বাবা নাজমুল ইসলামকে বিয়ে করেছেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

দুই যমজ সন্তান ধ্রুব ও রুদ্রের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, সে সময় সংসারে নতুন অতিথির অপেক্ষায় ছিলেন রিফাত সুলতানা ও নাজমুল ইসলাম দম্পতি। করোনা মহামারির ওই ভয়ংকর সময়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন রিফাত। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকালে মেয়ে হৃদিতা সুলতানার জন্ম দিয়ে বিকেলে মারা যান তিনি। সে সময় মা হারানো এই তিন শিশুর সহায় হয়ে ওঠেন তাদের খালা রুখসাত সুলতানা। পরম মমতায় তাদের আগলে রাখেন তিনি। দুই বছরের বেশি সময় মায়ের অভাব পূরণকারী রুখসাত এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তিন শিশুর মায়ের আসনে বসলেন।

নাজমুল ইসলাম ও রুখসাত সুলতানার নতুন জীবন শুরু হলো আজ
ছবি: সংগৃহীত

আজ শুক্রবার দুপুরে নাজমুল ও রুখসাতের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পরই মুঠোফোনে রুখসাত সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপু মারা যাওয়ার সময় তাঁর তিন সন্তানকে আমার হাতেই তুলে দিয়েছিল। ধ্রুব আর রুদ্র আপু থাকতেই আমাকে আম্মু ডাকত। এখন অফিশিয়ালি আমি ওদের তিনজনের মা হলাম। ওদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমরা সিদ্ধান্তটা নিলাম।’

রিফাত সুলতানা একাত্তর টেলিভিশনের সহকারী প্রযোজক ছিলেন। আর নাজমুল ইসলাম একই টেলিভিশন চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিয়ের ১০ বছরের মাথায় তাঁরা তিন সন্তানের মা ও বাবা হয়েছিলেন। ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল মারা যান রিফাত। সে সময় এক মাসের মধ্যে করোনায় স্ত্রীর পর মা–বাবাকেও হারিয়েছিলেন নাজমুল।

ওই দুঃসময়ে রুখসাত সুলতানা যেভাবে তাঁদের সন্তানদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেন, তা স্মরণ করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নাজমুল। গতকাল এক ফেসবুকে পোস্টে তিনি লিখেছেন, রিফাতকে হারিয়েছেন দুই বছর দুই মাস ছয় দিন আগে। এই সময়ে তিন বাচ্চার গায়ে কোনো আঁচ লাগতে দেননি রুখসাত সুলতানা (চাঁদনী)। রিফাতকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার দিন থেকেই রুখসাত খালা থেকে মা হয়ে থেকে গিয়েছিলেন। আর দুই বাচ্চা তো আগে থেকেই তাঁকে আম্মু ডাকত।

ধ্রুব ও রুদ্র—দুই ভাই বুঝতে পেরেছে, তাদের মা রিফাত সুলতানা আর ফিরবেন না
ছবি: সংগৃহীত

নাজমুল লিখেছেন, ‘মাম্মাম (রিফাত) না থাকার কষ্টটা আসলে ওরা বুঝতেই পারেনি ওদের আম্মুর জন্য। চাঁদনীও দিন নেই রাত নেই, ওদের নিয়ে পড়ে থাকল সব শখ–আহ্লাদ বাদ দিয়ে। ...আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। অবশেষে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমি আর চাঁদনী সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করার। বাচ্চাদের এক মা চলে গেছে, আরেক মায়ের থেকে কখনো যেন বঞ্চিত না হয়।’

রুখসাত সুলতানার মতে, যেকোনো মেয়ের জন্যই এভাবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক কঠিন। সে কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিয়েছেন তিনি।

বোনের তিন সন্তানকে আগলে রাখতে গিয়েই আইন পেশায় থিতু হতে পারেননি রুখসাত সুলতানা। তিনি বলেন, ‘সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে দুই পরিবারের মুরব্বিরাই এমন বিয়ের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। তবে আমার বেলায় তা হয়নি। আর ছেলেমেয়েরা এখন বড় হচ্ছে। ওরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তাই আমরা দুজন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে দুই ছেলেকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছি। তারাও খুব খুশি।’

নাজমুল ফেসবুক পোস্টে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়ানো এবং একটু অক্সিজেন সাপোর্ট পেতে আকুতি জানানোর কথাও তুলে ধরেছেন। তখন নাজমুল নিজেও করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।

সেই সব দিনের স্মৃতি হয়তো নাজমুল ও রুখসাতকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তাই রিফাত মারা যাওয়ার পর পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান, ছেলেমেয়েদের জন্মদিন বা যেকোনো আয়োজনে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে নাজমুল আর রুখসাত রিফাতের কথা স্মরণ করেছেন। কেননা, রিফাত না থাকলেও তাঁর রেখে যাওয়া তিন সন্তানকে নিয়েই তো ছিলেন দুজন। এখন তাঁরা নববিবাহিত দম্পতি, এই তিন সন্তানের মা–বাবা।

বোন রিফাত সুলতানার তিন সন্তানকে এভাবে আগলে রেখেছেন রুখসাত সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

রিফাত তাঁর অনাগত সন্তানকে টুকি ডাকতেন। জন্মের পর থেকে টুকি তো রুখসাতের বুকের ওমেই বড় হয়েছে ও হচ্ছে। আর রিফাত মারা যাওয়ার পর যমজ দুই ছেলের ‘মাম্মাম আসে না কেন, কবে আসবে’—এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে রুখসাতকে। তারপর আস্তে আস্তে ওদের মাম্মাম মারা গেছেন, আর কখনো ফিরবেন না—এ সত্যও জানান দিতে হয়েছে তাঁকেই। এখন সামনের সব ঝড়ঝাপটাও তাঁকে সামলাতে হবে।

নাজমুল তাঁদের নতুন জীবনের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিয়ের কথা শুনে অনেকে যেমন শুভকামনা জানিয়েছেন, অনেকে আবার নানা বাজে কথাও বলবেন। বাজে মন্তব্য করাটাই সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমাদের একটাই চাওয়া, আমাদের সন্তানেরা ভালো থাকুক।’