ঢাকা মেডিকেলে ভিড়, আহতদের আর্তনাদ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সরকারের নির্দেশে দেশের ভেতরে সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। এ কারণে প্রথম আলো ডটকমে কোনো সংবাদ বা লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এ কয়েক দিনে নানা ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত–সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৮৭ জন। সংকট নিরসনে সরকারও একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ সময়ে ছাপা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য সংবাদ ও লেখাগুলো অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। এই প্রতিবেদনটি ২০ জুলাই শনিবার প্রকাশিত হয়।
১২ বছরের শিশু ইমনের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরছিল। ট্রলিতে শোয়া। তলপেটের নিচ থেকে সাদা চাদরে ঢাকা। চারপাশে অপরিচিত লোকজনের ভিড়ে তার চোখেমুখে দিশাহারা ভাব। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে কান্নার দমক আরও বেড়ে যায়। সঙ্গের একজন শুধু বললেন, রাজধানীর বাড্ডার রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ইমনকে পাওয়া গেছে। ডান পায়ের ঊরুতে গুলি লেগেছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ইমনকে এভাবে দেখা যায়।
শুধু ইমন নয়, একের পর এক আহত ব্যক্তিদের ট্রলিতে করে হাসপাতালে আনা হয়। কিছুক্ষণ পরপরই আসছিল বুলেটবিদ্ধ বা হামলায় আহত নানা বয়সী মানুষ। কারও হাত, কারও ঊরু, কারও তলপেট, বুক, পিঠ, কারও মাথা বুলেটবিদ্ধ। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল তারা।
গতকাল সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া ও মোহাম্মদপুর থেকে ৫৩ জন ভর্তি।
জরুরি বিভাগের তথ্য অনুসারে, গতকাল সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া ও মোহাম্মদপুর থেকে ৫৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। বেলা দেড়টার দিকে মারা যান রামপুরায় পুলিশের গুলিতে আহত রাকিব (২৩) নামের এক তরুণ। আফতাবনগর এলাকার জহুরুল ইসলাম সিটিতে তাঁর বাসা। স্থানীয় বিদ্যুৎ কার্যালয়ে আউটসোর্সিং হিসেবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসক মুসরাত আফরিন।
আগের দিন বৃহস্পতিবার যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের দেখতে ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ১৭ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্থানের অভাবে আরও ১৩ জনকে স্থানান্তর করা হয়েছে বার্ন ইউনিটে। ওই ওয়ার্ডে ঘণ্টাখানেক থাকার পর জরুরি বিভাগের সামনে এসে দেখা যায়, আহত রক্তাক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে স্বজন, পথচারী, চিকিৎসক ও স্টাফদের ছোটাছুটি।
কিছুক্ষণ পরপর আসছিলেন আহতেরা
মিরাজ নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসেন কমপক্ষে সাত–আটজন। তৌহিদ নামের এক ব্যক্তি জানান, মিরাজ পড়াশোনার পাশাপাশি রামপুরায় একটি ক্লিনিকের হিসাব বিভাগে খণ্ডকালীন কাজ করেন। রামপুরায় বিক্ষোভের সময় তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ হন।
কাজলা এলাকা থেকে আনা হয় বেল্লাল (৩২), আবদুল গণি (৩৫) ও হোসেন (২৪) নামের আহত তিনজনকে। বেল্লালকে হাসপাতালে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সাইদুল ইসলাম নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, বেল্লাল কাজলা বাজারের ডাব ব৵বসায়ী। হুট করে কোথা থেকে আসা গুলি বেল্লালের ডান হাত ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে আনা হয় মোরশেদ, ফোরকান, নাইমকে এবং কাজলা থেকে রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল চালক কামালকে (৩৫)। কামাল জানান, তিনি জীবিকার কারণে বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
অমিত (১৪) নামের আরেক শিশুকে ওই সময় দেখা যায় রক্তাক্ত পিঠ নিয়ে জরুরি বিভাগে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে আসতে থাকেন মোহাম্মদপুর থেকে মামুন, রামপুরা থেকে অটোরিকশাচালক আনোয়ার (৩০), যাত্রাবাড়ী থেকে মুক্তার হোসেন (৪৫), রামপুরা থেকে হাসিবুল (৩৫) নামের আহত ব্যক্তিরা।
ক্যাজুয়ালটি বিভাগ থেকে জানানো হয়, ওই বিভাগে ভর্তি লিটন (২১) নামের একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁকে রামপুরা থেকে আনা হয়েছে। তাঁর নাভির পাশ দিয়ে গুলি ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। রোগীর চাপ সামলাতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে।
‘ছেলেডার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন’
রোমান ঢালী (১৭) উত্তরায় একটি বায়িং হাউসে পিয়ন হিসেবে চাকরি করে। গত বৃহস্পতিবার আজমপুরে পদচারী–সেতুতে থাকা অবস্থায় তার পা ও কোমরে গুলি লাগে। তার শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে মা রুমা আক্তার ও বাবা ফুসফুসে ক্যানসার আক্রান্ত রুবেল ঢালী জানান, ছেলে ছোট হলেও সংসারের বেশির ভাগ দায়িত্ব ওর কাঁধে। ওই ওয়ার্ডে গতকাল আহত অবস্থায় ভর্তি হন ৩০ জন। এর মধ্যে ১৩ জনকে বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মোসাম্মৎ ইয়াসমিনও। তাঁর অটোরিকশাচালক স্বামী মো. শাহীন বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় ফেরার সময় কোমরে গুলিবিদ্ধ হন।
কাজলায় বিক্ষোভের সময় গুলিবিদ্ধ সাকিব হোসেনকে (২২) বিমর্ষ অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁর মা রেহানা আক্তার বলেন, ছেলের হাতে গুলি লেগেছে, মাথায় গভীর ক্ষত। ছেলের বন্ধু গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। ছেলে সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারছেন না।
এ ছাড়া কলেজছাত্র ইমরান ও নিহান মাহমুদ, মাদ্রাসাছাত্র আবদুর রব, স্কুলছাত্র সাকিবুল হাসান আহত অবস্থায় এখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। রিয়াজুল ইসলাম নামের চিকিৎসাধীন একজন জানান, তিনি বিক্ষোভে ছিলেন না। আজিমপুর কোয়ার্টার প্রাঙ্গণে বসে ছিলেন। রাত পৌনে নয়টার দিকে পুলিশ সেখানে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ওই সময় তাঁর তলপেটের নিচে গুলি ঢোকে।