শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত তালিকা হয়নি, এটি জাতীয় ব্যর্থতা

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুরফাইল ছবি

বুদ্ধিজীবীর মূল কাজ হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলা। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ সুবিধা নিতে শাসকদের তোষামোদে শামিল হয়। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর ধরে এটি ঘটছে। অথচ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত তালিকা হয়নি, এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়নি, এমনকি দাবিটাও জোরালোভাবে ওঠেনি। এটি জাতীয় ব্যর্থতা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। আজ শনিবার একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এ আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সময় বুদ্ধিজীবীরা নিন্দিত হয়েছেন, তাঁরা সরকারের দালালি করতেন। অল্প কয়েকজন ছিলেন, যাঁরা মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন।

ইতিহাস নিয়ে অভিযোগ আছে, বিকৃতি আছে উল্লেখ করে আবুল কাসেম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিহাস চর্চায় নজর দেয়নি, চাকরির জন্য গবেষণা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও দলাদলি থাকে। দলের পক্ষ নেয় সুবিধা নিতে। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী ছিল বেশি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কেউ তাঁকে নিয়ে বিবৃতি দেয়নি। ১৯৭৫ সালেও এমনটা দেখা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐক্য নিয়ে আওয়ামী লীগের বাইরে চিন্তা করেননি শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁদের বিবেচনায় নেননি। এটা না করার ফল খারাপ হয়েছে। রাজনীতিবিদদের প্রতি বিরূপ মনোভাব কেন হবে! এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চায় না, গরিব দেশে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠুক। সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, যে কারণে ’৭১–এ বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়েছেন, সেই কারণ এখনো রয়ে গেছে। ’৭২ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর চর্চা করে যাচ্ছে। একই শাসনযন্ত্র কাজ করছে ৫৩ বছর ধরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার অঙ্গীকার পূরণ না হওয়ায় ’৯০ হয়েছে, ’৯০–এর অঙ্গীকার পূরণ না হওয়ায় ২০২৪ হয়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে, আয়নাঘর হয়েছে, বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেনি। কথা বলেছে ছাত্ররা। এবারের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে আরও বড়ভাবে মানুষ রাস্তায় নামবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বুদ্ধিজীবী নিধনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রাজাকার, আলবদর যুক্ত ছিল। যারা হত্যায় জড়িত, দিবসের অনুষ্ঠানে তাদের কথা ঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না। বিচারের তদন্ত হয়নি, দাবিটাও জোরালোভাবে ওঠেনি। আইনগতভাবে যা নিষ্পত্তি করার সুযোগ এখনো আছে, সেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বিচার বিভাগের সমালোচনা করে জ‍্যোতির্ময় বড়ুয়া আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগ কীভাবে সরকারকে স্বৈরাচার বানাতে পারে, তার নমুনা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ। কোটা নিয়ে রায় থেকেই আন্দোলনের শুরু, ভুল রায়ের জন্য কতগুলো প্রাণ ঝরে গেছে। আদালতের একটা ভুল সিদ্ধান্ত সরকার পরিবর্তন করে দিতে পারে। কখনো ভাবা যায়নি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ’৭১–এর চেয়ে বেশি নৃশংসতা হয়েছে ২০২৪–এ এসে। ৬ আগস্টের পরের নৃশংসতাও দেখে আত্মশুদ্ধির কথা ভাবতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, বুদ্ধিজীবীদের কাজই হচ্ছে ক্ষমতার বয়ানকে প্রশ্ন করা। ’৭১–এ যাঁদের মারা হয়েছে, তাঁরাও ক্ষমতার বিপক্ষে বয়ান হাজির করেছিলেন। তাঁদের থামিয়ে দিয়ে প্রতিবাদের বয়ান বন্ধ করতে চেয়েছিল। অন্যায়, অবিচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই বুদ্ধিজীবী।

গত ৫৩ বছরে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা প্রবলভাবে কমে এসেছে উল্লেখ করে সামিনা লুৎফা আরও বলেন, এটি সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত। বুদ্ধিকে তাঁরা চালাকিতে পরিণত করে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছেন। এ কারণে ২০২৪–এ অনেকে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন। বরং যাঁরা সাহস করে দেয়ালে মানুষের মনের কথা লিখেছেন, তাঁরাই বড় বুদ্ধিজীবী।

আলোচনার শুরুতে সদ্য প্রয়াত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার ও কবি হেলাল হাফিজ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব মো. নায়েব আলী।