বীর আবু সাঈদ এলেন শিল্পকর্মে
কিছু কিছু ঘটনা, নাম, কিছু দৃশ্য সময়কে ছাপিয়ে চিরন্তন হয়ে ওঠে। কেবল স্মরণ করা মাত্র বা একঝলক দেখাতেও যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তা চিনতে ও মনে করতে পারেন। যেমন আসাদ, মতিউর বা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা নূর হেসেনের ছবি দেখলেই সংশ্লিষ্ট ঘটনা, ইতিহাস গণমানুষের স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
গত জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এমনই কিছু কালজয়ী দৃশ্য রচনা করেছেন অকুতোভয়, প্রতিবাদী জনতা। তেমনই এক ছবি দুই হাত প্রসারিত করে বুক টান করে দাঁড়ানো এক নির্ভীক প্রতিবাদী তরুণের। গণমানুষ এই তরুণকে আর কোনো দিন ভুলতে পারবে না। তিনি শহীদ আবু সাঈদ। ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপুল রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের উজ্জ্বলতম প্রতীক। ইতিহাসের অম্লান এই তরুণকে শিল্পকলায় অভিষিক্ত করলেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পী শহীদ কবির।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী শিক্ষার্থী, শহীদ হওয়ার পরে যাঁর স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার ফল প্রকাশিত হয়েছে, যা তিনি জেনে যেতে পারেননি, সেই বীর আবু সাঈদকে নিয়ে এচিং মাধ্যমে এক অনবদ্য চিত্রকলা করেছেন শহীদ কবির। অবশ্য গত ১৬ জুলাই শহীদ হওয়ার পর থেকেই আবু সাঈদ গণ–আন্দোলনের সাহস ও প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর ছবি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশ–বিদেশে বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অভ্যুত্থানের পরে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা যেসব গ্রাফিতি করেন, তাতে আরও অনেক শহীদের প্রতিকৃতির সঙ্গে দুই বাহু প্রসারিত আবু সাঈদ উঠে এসেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে।
শহীদ আবু সাঈদকে শিল্পকর্মে আনার বিষয়টি কেমন করে ভেবেছিলেন শহীদ কবির? তিনি জানান, বছর দুয়েক আগে এচিংয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি পোর্ট্রেট করেছিলেন। প্রথম আলো পত্রিকার অতিথিদের উপহার দেওয়ার জন্য সম্পাদক মতিউর রহমানের অনুরোধে তিনি সেই কাজ করেছিলেন। এর দুই শতাধিক কপি করা হয়েছিল। এবারও সম্পাদক তাঁকে অনুরোধ করেন প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অতিথিদের উপহার হিসেবে কবির আরেকটি প্রতিকৃতি করে দেওয়ার জন্য। শহীদ কবির বলেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, আবার নজরুল কেন, আবু সাঈদকে নিয়ে কেন আমরা কিছু ভাবছি না? তাঁকে নিয়ে হতে পারে এ সময়ের সদ্য এক ঐতিহাসিক ঘটনার শিল্পকর্ম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “এটা খুব চমৎকার চিন্তা। বীর আবু সাঈদ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের প্রধান প্রতীক। তাঁকে নিয়ে করা কোনো শিল্পকর্ম যদি আমাদের অতিথি, বন্ধু-সুহৃদদের উপহার দিই, তাহলে সেটি খুব ভালো বিষয় হয়। এটা বর্তমান সময়ের সঙ্গে ভালোভাবে যায়।” তিনি সম্মতি দেওয়ার পর আমরা কাজ শুরু করি।’
শহীদ কবির বলেন, ‘আবু সাঈদ একটা প্রতীক। পুলিশের গুলির মুখে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, আমার মনে হয়েছিল পুরো আন্দোলন-অভ্যুত্থানের প্রতীক হিসেবে তাঁকে নেওয়া যায়। এ জন্য আমি প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। আমাকে ৮০০ কপি তৈরি করে দিতে বলা হয়েছিল। এচিং সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন, চিত্রকলার এটি অনেক সময় ও পরিশ্রমসাপেক্ষ মাধ্যম। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। আর্ট হিসেবে নয়, টেকনিক্যালি খুব কঠিন। সাধারণত জিংক বা কপার প্লেটে এচিংয়ের ড্রয়িং করতে হয়। এটা প্রথমে নিডল দিয়ে কাটতে হয়। তারপর অ্যাসিড ও পানির দ্রবণে দিতে হয়। অ্যাসিড ধীরে ধীরে কাটা অংশগুলো খেতে থাকে। সময়ের দিকে লক্ষ রাখতে হয়। এটা সরাসরি শুধু শিল্পীর আর্ট নয়। এটা শিল্পী, অ্যাসিড, মেশিন ও কাগজের একটা সম্মিলিত শিল্প। আর ৮০০ প্রিন্ট একা করা অসম্ভব। ইউরোপে যখন থাকতাম, তখন একটা এচিংয়ের ৫০–১০০টি প্রিন্ট করেছি। কিন্তু ৮০০ প্রিন্ট কখনো করিনি।’
কাজটি করার জন্য শহীদ কবির সহায়তা নেন তাঁর অনেক দিনের সহযোগী তরুণ শিল্পী ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) চারুকলার শিক্ষক ঢালী তমালকে। কাজটি শুরু হয় লালমাটিয়ার কিবরিয়া প্রিন্ট মেকিং স্টুডিওতে। তমাল ও তাঁর শিক্ষার্থীরা মিলে শহীদ কবিরের নেতৃত্বে চলে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ।
কাজটি করতে গিয়ে প্রথম দুটি প্লেট নষ্ট হয়ে যায়। খুব মুষড়ে পড়েছিলেন শিল্পী শহীদ কবির। হাতে সময় ছিল মাত্র ২২ দিনের মতো। স্টুডিওতে আরও দুটি অতিরিক্ত প্লেট ছিল। সেই দুটিতে নতুন করে কাজ করেন। এতেই প্রায় ১০ দিন চলে যায়। এরপর শুরু হয় প্রিন্ট তোলার মহাব্যস্ততা। ঢালী তমাল বলেন, ‘একটি প্লেটে এত প্রিন্ট অসম্ভব। তাই দুটি প্লেট করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সময় ও শ্রমসাধ্য কাজ। কাজের মান নিশ্চিত করতে খুব সতর্ক থাকতে হয়। প্রতিটি প্রিন্টের পরে প্লেট পরিষ্কার করে রং লাগাতে হয়। ফলে একটি প্রিন্ট তুলতেই প্রায় ২০ মিনিটের মতো সময় চলে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি আমরা করতে পেরেছি। স্যারের সঙ্গে কাজ করে অনেক কিছু আমরা শিখতে পেরেছি। কাজটি সমসাময়িক ঘটনাকে ধারণ করেছে। আর পরিমাণের দিক থেকেও দেশে ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে সব থেকে বড়, তাই এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে আমরা সবাই খুব আনন্দিত।’
শহীদ কবির জানালেন, এত অল্প সময়ে এত বিপুল শিল্পকর্ম করা একটা অসাধ্য সাধন হয়েছে বলে মনে করে প্রথম আলো। সম্পাদক জানিয়েছেন, এগুলো তাঁরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপহার দেবেন। তাঁদের বাড়িতে, ঘরে, অফিসে এটা প্রদর্শিত হবে। এভাবে একজন শহীদ, একজন প্রতীক, একজন বীরের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানানো হবে। আর প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ তারা মগ বা ফুলদানি উপহার দেওয়ার পরিবর্তে অতিথিদের শিল্পকর্ম উপহার দেওয়ার কথা ভেবেছে। আর সহশিল্পীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, জুলাই–আগস্টের বিপ্লব বাংলাদেশের একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তন। সমাজ ও ইতিহাসে দীর্ঘদিন এর প্রভাব থাকবে। আর আবু সাঈদের প্রতিকৃতি থেকে প্রাণিত এই শিল্পকর্ম বাংলাদেশের যেসব ছাত্রছাত্রী, তরুণ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশ নিয়েছেন, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, যাঁরা আহত হয়েছেন, যাঁরা এখনো চিকিৎসাধীন, সবার প্রতি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্মারক হয়ে থাকবে।