সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন মাথায় গুলিবিদ্ধ শিশু মুসা তাকাচ্ছে, হাত-পা কিছুটা নাড়াচ্ছে

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুসা
ছবি: মুসার মা নিশামনির সৌজন্যে

‘মুসা, মুসা; পা ওপরে তোলো’—চিকিৎসকের এমন নির্দেশনা শিশুটি বুঝল কি না, বোঝা গেল না। কারণ, তার দৃষ্টি অর্থপূর্ণ ছিল না।

তবে শিশুটি তার বাঁ পা কিছুটা নাড়ল। চেহারায় একমুহূর্তের জন্য বেদনার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। চিকিৎসকের হাত তখন মুসার হাতের কাছে। স্পর্শ পেয়ে চিকিৎসকের হাত নিজের বাঁ হাতের মুঠিতে নিল শিশুটি। তখন চিকিৎসকের মুখে চওড়া হাসি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাসার নিচে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সাত বছর বয়সী শিশু মুসা। এখন তার চিকিৎসা চলছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। গত বুধবার হাসপাতালে ধারণ করা তার এক ভিডিও চিত্রে এমন দৃশ্য দেখা গেল।

এই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সবচেয়ে কম বয়সী শিশু মুসা। তাকে নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো। প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় গত ২৮ জুলাই। গত ৭ অক্টোবর ‘আন্দোলনকালে গুলিবিদ্ধ শিশু মুসাকে সিঙ্গাপুরে নিতে বলছেন চিকিৎসকেরা, কে দেবে এত টাকা’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর গত ২২ অক্টোবর উন্নত চিকিৎসার জন্য মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠায় সরকার।

আরও পড়ুন
গত ২২ অক্টোবর উন্নত চিকিৎসার জন্য মুসাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়
ফাইল ছবি

মুস্তাফিজুর রহমান ও নিশামনি দম্পতির একমাত্র সন্তান বাসিত খান মুসা। পরিবারটির বসবাস রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায়। মালিবাগে মুসার বাবা ও দাদার ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান আছে। গত ১৯ জুলাই মেরাদিয়া হাট এলাকায় নিজ বাসার নিচে মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে নেমে নাতিসহ দাদি মায়া ইসলাম (৬০) গুলিবিদ্ধ হন। মায়া ইসলাম পরদিন মারা যান।

গুলিবিদ্ধ মুসাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। গত ২৬ আগস্ট তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিউরোসার্জারি বিভাগে (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) স্থানান্তর করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর তাকে স্থানান্তর করা হয় সিএমএইচের শিশু নিউরোলজি বিভাগে।

সিএমএইচে মুসা জ্যেষ্ঠ নিউরোসার্জন অধ্যাপক কর্নেল মো. আল আমিন সালেক ও পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদের অধীন চিকিৎসাধীন ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করেছিলেন তাঁরা। তবে সিঙ্গাপুরে মুসার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থ জোগাড় করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাসার নিচে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সাত বছর বয়সী শিশু মুসা
ফাইল ছবি

এ-সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর চ্যানেল আই মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য বিনা মূল্যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেয়। সরকার সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে মুসার চিকিৎসা নিশ্চিত করে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২০তম ব্যাচের চিকিৎসকদের উদ্যোগে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত চিকিৎসক, প্রবাসীসহ সাধারণ মানুষ অর্থসহায়তা দিয়ে মুসার পাশে দাঁড়ান।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মুসার চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসায় তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে তাকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিও) স্থানান্তর করা হয়েছে।

মুসার সঙ্গে রয়েছেন তার মা নিশামনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলের এখন লাইফ সাপোর্ট লাগছে না। সে নিজে থেকে হাত-পা কিছুটা নাড়াতে পারছে। চোখ খুলে তাকাচ্ছে। আগে সে চোখের পাতা ফেলত না। তবে এখন ফেলছে। তবে তার দৃষ্টি অর্থপূর্ণ নয়। চোখের সামনে আলো ধরলে বা আঙুল নিয়ে গেলে সে সাড়া দেয় না।

মুস্তাফিজুর রহমান ও নিশামনি দম্পতির একমাত্র সন্তান বাসিত খান মুসা
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে পাওয়া

সিএমএইচের চিকিৎসক অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদ প্রথম আলোকে জানান, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শুরুর পর মুসার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। দেশে চিকিৎসার সময় তার দেহ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে পড়েছিল। রক্তে সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছিল না। তাই শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। তবে সংক্রমণ এখনো রয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মুসার দেহে এখনো সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বিশ্বে কম ব্যবহার হয় এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে তার দেহের সংক্রমণ কমানো হয়েছে। মুসার সার্বক্ষণিক লাইফ সাপোর্ট লাগছে না। তাকে আইসিইউ থেকে কয়েক দিন আগে এইচডিওতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাকে টিউবে করে খাওয়ানো হচ্ছে। খাবার হজমও হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কাছ থেকে জানা যায়, গুলি মুসার মাথার বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে বের হয়ে যায়। তার মাথায় এখন কোনো গুলি নেই। তবে গুলিতে মুসার মস্তিষ্ক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার শরীরের ডান পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মাথায় এখন অতিরিক্ত পানি তৈরি হচ্ছে। সাময়িকভাবে এই পানি বের করে দেওয়া হচ্ছে।

অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদ বলেন, গুলিতে মুসার মাথার হাড় ভেঙে গেছে। সেখানে নতুন হাড় লাগাতে হবে। তাঁরা (চিকিৎসকেরা) মুসার সুস্থ হয়ে ওঠার বিষয়ে খুবই আশাবাদী। তবে তার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে।

গুলিবিদ্ধ মুসাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সে সময় তার পাশে বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ও মা নিশামনি
ফাইল ছবি

মুসার চিকিৎসার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে। গত বুধবার মুসার চিকিৎসার সবশেষ অবস্থা জানাতে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা সিএমএইচের চিকিৎসক, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি জুম বৈঠক করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে মুসার ৫০ দিনের চিকিৎসার জন্য অর্থ জমা দিয়েছে। তবে ব্যয়বহুল ওষুধ লাগায় হাসপাতালে জমা দেওয়া অর্থ আগামী ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠিত স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত সরকার ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে। এই অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থের বিষয়ে সরকারের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। মুসা এই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ঘটনা। কোনোভাবেই যেন তার চিকিৎসা ব্যাহত না হয়, সেদিকে সরকারের নজর রয়েছে।

বাসিত খান মুসা
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে পাওয়া

মুসার বিষয়ে কথা বলা প্রত্যেকে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, দেশের মতো সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের কাছেও মুসা ‘এক বিস্ময় শিশু’। তার বেঁচে থাকাকে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হয়েছে তাঁদের কাছে। একের পর এক অস্ত্রোপচারের ধকল সহ্য করা মুসা তাঁদের কাছে ‘লড়াকু শিশু’। শীর্ণ দেহের সাত বছরের শিশুটির লড়াই চিকিৎসকদের মধ্যে তার বেঁচে থাকা, সুস্থ হয়ে ওঠার বিষয়ে আশা জাগিয়েছে।

মুসার মা নিশামনি বলেন, মুসার কথা প্রথম দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে প্রথম আলো। তার বিদেশে চিকিৎসায় সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম আলো তুলে ধরে। মুসার জন্য এগিয়ে আসা প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, সবার দোয়া-ভালোবাসায় সন্তান সুস্থ হয়ে উঠবে। কোনো একদিন হুট করে তাঁকে আবার ‘মা’ বলে ডেকে উঠবে মুসা।