‘অনেক কিছুই পরিমাপ করা যায়। কিন্তু আনন্দ-বেদনা পরিমাপ করা যায় না কেন?’ এ প্রশ্ন আদিব শাহরিয়ার নামের এক শিক্ষার্থীর। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালির সেন্ট প্লাসিডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত গণিত উৎসবে যোগ দিয়ে এই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আদিব। এমন আরও মজার প্রশ্ন উঠে আসে এ উৎসবের প্রশ্নোত্তর পর্বে।
‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’স্লোগানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গণিত উৎসবের এ আয়োজন করে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। সেন্ট প্লাসিডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত উৎসবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৬৫০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ১২৬ শিক্ষার্থীকে সনদ ও পদক দেওয়া হয়।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয়। এতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ব্রাদার চন্দন গোমেজ, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার দে। এ ছাড়া বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন।
আয়োজনে সহযোগিতা করেছে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি উপজেলার বন্ধুসভা। বিশ্বজিৎ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘গণিতের ভয় দূর করতে হবে। গণিত মজার। আনন্দ নিয়ে গণিতের চর্চা করতে হবে।’
উদ্বোধনের পর সকাল ১০টা থেকে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষে গণিতের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার পর বন্ধুসভার সদস্যদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর ছিল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ পর্বে শিক্ষার্থীরা একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দেন আলোচকদের। গণিত নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার রায়, গণিত বিভাগের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার দে, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. ইফতেখার মনির ও সিএসই বিভাগের অধ্যাপক তৌফিক সাইদ। সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যিক আনিসুল হক।
আদিব শাহরিয়ারের ওই প্রশ্নের জবাবে শিক্ষকেরা বলেন, পরিমাপ সব সময় কোনো নির্দিষ্ট স্কেল দিয়ে করতে হবে, এমন নয়। মনোবিজ্ঞানে একটি পরীক্ষা রয়েছে, যেটিকে ইংরেজিতে সাইকোমেট্রিক টেস্ট বলা হয়। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা হয়। এসব প্রশ্নের সাহায্যে কে কতটুকু আনন্দিত, কে কতটুকু হতাশ, তা বের করেন চিকিৎসকেরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আনন্দ-বেদনাও পরিমাপ করা সম্ভব।
গণিত উৎসবে শিক্ষার্থীরা যেমন এসেছিল, তেমনি এসেছিলেন অভিভাবকেরাও। সকাল সাতটার মধ্যেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের পদচারণে। উৎসবে কিশোর আলো, গণিত অলিম্পিয়াড, দ্বিমিক প্রকাশনী, ল্যাব বাংলা বইয়ে স্টলও বসে। সেসব স্টল ঘুরে দেখেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
সমাপনী বক্তব্যে আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের চারপাশে যা কিছু আনন্দের, যা কিছু উপভোগের, সবকিছুই করব। আমরা বিজ্ঞান ক্লাব করব, পরিবেশ ক্লাব করব, বিতর্ক ক্লাব করব। আমরা গল্প পড়ব, উপন্যাস পড়ব, কিশোর আলো পড়ব, বিজ্ঞানচিন্তা পড়ব। পাশাপাশি রেজাল্টও ভালো করব।’
রংপুরের উৎসবে হাজার শিক্ষার্থী
গতকাল রংপুরেও বসেছিল আঞ্চলিক গণিত উৎসবের আসর। রংপুর জিলা স্কুল মাঠে গণিত উৎসবের আয়োজন করা হয়। রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ পাঁচ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ১৫০ জন শিক্ষার্থী এ উৎসবে অংশ নেয়।
সকাল ৯টায় বন্ধুসভার সদস্যদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ গণিত উৎসবের পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক মোহসীন আলী ও রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ আর মিজানুর রহমান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবদুল মান্নান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করতে গণিত উৎসব ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।’
উদ্বোধনী পর্বের পর শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে চলে যায় পরীক্ষা দিতে। সোয়া ঘণ্টার মূল্যায়ন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষে স্কুল মাঠে টানানো শামিয়ানার নিচে এসে বসে তারা। এরপর বন্ধুসভার বন্ধুদের পরিবেশনায় গণিতের গানসহ আরও কয়েকটি সংগীত পরিবেশন হয়। সংগীত পরিবেশনে অংশ নেন রংপুর বন্ধুসভার উপদেষ্টা রওশন আরা সোহেলী, রণজিৎ কুমার রায়, জাহাঙ্গীর কবির প্রমুখ।
সংগীত পরিবেশনার পর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর পর্ব। মঞ্চ থেকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন আমন্ত্রিত অতিথি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক তানজিম মুগ্ধ, একাডেমিক কাউন্সিলর জাহিদ হোসাইন খান, ম্যাথ ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তারিক প্রধান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ড্রিমস ফর টুমরোর সমন্বয়ক জাভেদ পারভেজ। সেই সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথিরাও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে আমন্ত্রিত শিক্ষকদের বক্তব্যের পর প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক ও প্রথম আলো রংপুর বন্ধুসভার সভাপতি রওনক জাহান খুশি শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে প্রাইমারি, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি এই চার ক্যাটাগরিতে ৭৩ জন বিজয়ীকে পদক ও টি-শার্ট দেওয়া হয়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় গণিত উৎসবের আয়োজন করছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। উৎসবের খবর মিলবে গণিত অলিম্পিয়াডের ওয়েবসাইট matholympiad.org.bd এবং facebook.com/BdMOC অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে।