ইন্টারনেটে অনেক কিছুর সমাধান পাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা
‘এখানে আসছি ইন্টারনেট সম্পর্কে জানতে। এসে দেখি এটা এমন একটা মাধ্যম, যেখানে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়।’ বলছিলেন নিয়োগী জোয়াইর গ্রামের বাসিন্দা মরিয়ম আক্তার। তিনি এসেছিলেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে।
ইন্টারনেট যে মানুষের নানা রকম চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করতে পারে—বিষয়টি সরাসরি শেখাতে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে দেশজুড়ে চলছে উঠান বৈঠক। ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ উদ্যোগটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি.। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান বাড়াতে দুই হাজার ইউনিয়নে আয়োজিত হচ্ছে উঠান বৈঠক। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় এই আয়োজন।
৩ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া টাঙ্গাইল জেলার উঠান বৈঠক ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ৩টায় নিয়োগী জোয়াইর ইউনিয়নে এবং বেলা ১১টায় কালিহাতী উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুটি উঠান বৈঠকই সঞ্চালনা করেন টাঙ্গাইল বন্ধুসভার পাঠাগার সম্পাদক মাহমুদা আক্তার।
চাঁন মাহমুদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে আসা অংশগ্রহণকারী নারীদের অর্ধেকের বেশিই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু গ্রামে থেকেও কীভাবে অনলাইনে বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, তা জানতেন না। এ বিষয়ে উঠান বৈঠকে উপস্থিত নারীদের ধারণা দেওয়া হয়, যা থেকে অনেকেই পেয়েছেন উদ্দীপনা ও উৎসাহ।
তেমনই একজন নিয়োগী জোয়াইর ইউনিয়নের গৃহিণী সাদিয়া বেগম। বৈঠক শেষে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় সন্তানদের হঠাৎ শরীর খারাপ হলে বুঝতে পারি না, কী করব। তখন বিভিন্নজনের ভুল পরামর্শও সঠিক মনে হয়। কিন্তু এখন আর অনভিজ্ঞ কারও কথা নয়, ইউটিউব থেকেই চিকিৎসা বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ শুনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ঘরে বসেও যে ব্যবসা করা যায়, তা জানতে পেরে খুব ভালো লাগছে। আমি চেষ্টা করব অনলাইনে কোনো একটা ব্যবসা শুরু করতে।’
কালিহাতী উপজেলার দশকিয়া ইউনিয়নে উঠান বৈঠকে আসা সালমা বেগম জানান ইন্টারনেট নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা। ১০ সেপ্টেম্বর সকালে মোংলা ফকিরের বাড়িতে আয়োজিত উঠান বৈঠকে এসে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নজরুল ইসলাম সৌদিপ্রবাসী। দুই-তিন বছর পরপর দেশে আসেন। তবে ভিডিও কলে প্রতিদিন কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ইন্টারনেট আছে তাই মনেই হয় না তিনি আমার থেকে দূরে আছেন।’
একই বৈঠকে অংশ নেন গৃহিণী রুমানা বেগম। তিনি রান্না শেখা, নাটক দেখা, গান শোনা ও সন্তানদের লেখাপড়াসহ দৈনন্দিন অনেক কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। রুমানা বলেন, ‘এখন আমার এমন হইছে যে একদিন না খাইয়া থাকলেও চলে; কিন্তু এক বেলা ইন্টারনেট না থাকলে চলে না।’
উৎসবমুখর পঞ্চগড়ের উঠান বৈঠক
উৎসবমুখর পরিবেশে ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে পঞ্চগড় জেলার ১২টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক। এরই মধ্যে একটি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার। স্থানীয় হাজেরা বেগমের বাড়িতে আয়োজিত উঠান বৈঠকে ছিল গ্রামীণ নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। বিভিন্ন পরিচিত খেলার মাধ্যমে প্রতিটি উঠান বৈঠকই আনন্দময় করে তোলেন সঞ্চালক হৈমন্তী বিশ্বাস। এরপর ধাপে ধাপে শুরু হয় বিভিন্ন পর্ব। কুইজের উত্তর দেওয়া, কাগজের ফুল বানানো, ঝুড়িতে বল নিক্ষেপসহ নানা খেলায় মেতে ওঠেন নারীরা। একসময় উঠান বৈঠক পরিণত হয় সংসারের নানা চাপ ও কর্মব্যস্ততা ভুলে সাময়িক বিনোদন ও প্রশান্তির উপলক্ষ।
ফলে আনন্দঘন এ আয়োজনে পুরস্কারজয়ীদের চোখে-মুখে ছিল উচ্ছ্বাস। বিজয়ীদের জন্য বিশেষ একটি পর্বে সুযোগ ছিল ঢাকা ব্যাংকের সৌজন্যে স্মার্টফোন জেতার। এ ছাড়া ছিল আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে নকিয়ার মোবাইল হ্যান্ডসেট কেনার সুযোগ। স্বাস্থ্যসচেতনতার বিষয়ে কুইজের উত্তর দিয়ে পুরস্কার জেতেন তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের কনপাড়া এলাকার আঁখি আক্তার। তিনি বলেন, ‘গ্রামের ভাবিদের দেখাদেখি ছোট বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে আমিও এসেছি। এখানে পুরস্কার পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। ভিডিও দেখে যেসব বিষয় জানলাম, সেখান থেকে প্রশ্ন করায় উত্তর দিতে সহজ হয়েছে।’
কাগজের ফুল বানিয়ে পুরস্কার জেতেন আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়া-ডাঙ্গাপাড়া এলাকার স্বপ্না বসাক এবং আন্ধারী বসাক। স্বপ্না বসাক জানান, এখানে এসে নিজের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট বিষয়ে অনেক কিছুই তিনি জেনেছেন। আর ফুল বানিয়ে পুরস্কার পাবেন সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানটি গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগাচ্ছে। তাই ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা যাতে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই আয়োজন করা হচ্ছে উঠান বৈঠক।
বিশেষ এই কার্যক্রম গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের ১ হাজার ১০১টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে।