সংঘর্ষে জড়ানো আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, নেওয়া হচ্ছে আদালতে
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর পরদিন আজ সোমবার আনসার বাহিনীর অনেক সদস্যকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, আজ বেলা পৌনে দুইটা পর্যন্ত ১৪৯ জন আনসার সদস্যকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নেওয়া হয়। তাঁদের ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়েছে। বিকেলে তাঁদের আদালতে তোলার কথা।
নিজেদের চাকরি জাতীয়করণসহ কয়েকটি দাবিতে আনসার সদস্যরা কয়েক দিন ধরে ঢাকায় বিক্ষোভ করছিলেন। গতকাল রোববার তাঁরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সচিবালয় ঘেরাও করে রাখেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানান।
ঘেরাও করে রাখায় সচিবালয় থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বের হতে পারছিলেন না। দিনভর রাজধানীতে ছিল ব্যাপক যানজট।
রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবাই ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে।
সচিবালয়ে আনসার সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেককে আটকে রেখেছেন, রাতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। আনসার সদস্যদের প্রতিহত করতে তাঁরা মিছিল নিয়ে সচিবালয় এলাকায় যান। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় কয়েকজন আনসার সদস্য আহত হন। আহত হন প্রথম আলোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আসিফ হাওলাদারও।
এর আগে গতকাল বিকেল চারটায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন আনসার সদস্যদের সাত প্রতিনিধি। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, আনসারদের মধ্যে বিশ্রামের যে প্রথা চালু আছে, সেটা থাকবে না। তাঁরা নিয়মিত চাকরি করে যেতে পারবেন।
বিকেলেই আনসারদের দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সময় আনসার সদস্যদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু বিকেল পাঁচটার দিকে আনসার সদস্যরা কর্মকর্তাদের ভেতরে জিম্মি করে তাঁদের প্রধান দাবি চাকরি জাতীয়করণ করতে চাপ দেন।
এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৫৫ হাজার আনসার সদস্যের চাকরি জাতীয়করণ করতে হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হবে। কত টাকা বাড়তি প্রয়োজন হবে, তা বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব বিশ্লেষণ না করে প্রজ্ঞাপন জারি করা যায় না। সরকারের এসব যুক্তি না মেনে সচিবালয়ের চারপাশ ঘেরাও করে রাখেন আনসার সদস্যরা।
এদিকে আজ আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে আনসার সদস্যদের সচিবালয় ঘেরাও পরিস্থিতি জানানো হয়। এতে বলা হয়, গতকাল আনসার সদস্যদের সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে সেনাবাহিনী। এরপর সেনাসদস্যরা সচিবালয়ে অনুপ্রবেশকারী এবং পরবর্তী সময়ে জীবন রক্ষায় নিরাপদ আশ্রয় চাওয়া কয়েকজন আনসার সদস্যকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন থাকা সেনাসদস্যরা সচিবালয় এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এবং সচিবালয়ের সব গেটে নিরাপত্তা জোরদার করেন। এদিন বিভিন্ন সময়ে আনুমানিক ১০ হাজার আনসার সদস্য সচিবালয় ঘেরাও করেন। তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের সাতজন উপদেষ্টাসহ সচিবালয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখেন।
আইএসপিআর বলছে, বিকেলে আনসার সদস্যদের শান্ত করার জন্য আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক সচিবালয়ে আসেন এবং আনসার সদস্যদের সব দাবি মেনে নেন। এরপরও আনসার সদস্যরা সচিবালয় এলাকা না ছেড়ে আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখেন। কিছু আনসার সদস্য সচিবালয়ের ৩ নম্বর গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। কয়েকজন আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্রদের ওপর অতর্কিত হামলা করেন। সচিবালয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর টহলের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় ছয় সেনাসদস্য আহত হন। তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোতায়েনরত সেনাসদস্যরা বারবার আনসার সদস্যদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁরা শান্ত না হওয়ায় আকাশের দিকে ২৭টি ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। পরে সচিবালয় এলাকায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়। আনসার সদস্যদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
অবরুদ্ধ সাত উপদেষ্টা, আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর সহায়তায় সচিবালয় এলাকা ছেড়ে যান।
সংঘর্ষের ঘটনায় আজ বেলা দুইটা নাগাদ শাহবাগ থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছিল। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবুদ্দিন শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করবে।