বিআরটিএর হিসাব
যানবাহন নিবন্ধন ৩৮% কমেছে
ডলার–সংকট, দাম বেড়ে যাওয়া ও সংসারে মূল্যস্ফীতির চাপ, নির্বাচনী অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে যানবাহন কেনাবেচায়।
দেশে নতুন গাড়ি বিক্রিতে ভাটার টান দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক, পিকআপসহ প্রায় সব ধরনের নতুন যানবাহনের নিবন্ধন আগের বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও যানবাহন বিক্রেতারা বলছেন, নিবন্ধন কমে যাওয়া মানে বিক্রি কমে যাওয়া। বিক্রি কমার পেছনে মোটাদাগে তিনটি কারণ রয়েছে। এক, চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে সংসারে চাপ বেড়েছে। এতে নতুন গাড়ি কেনার আগ্রহ কমেছে। দুই, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে গাড়ির দামও বেড়ে গেছে। তিন, নির্বাচনের বছরে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা।
বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০২২ সালে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছিল। গত বছর সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৬১টিতে। অর্থাৎ এক বছরে দেশে ২ লাখ ১৭ হাজার ২৯০টি যানবাহনের নিবন্ধন কমেছে।
বিআরটিএ যানবাহন নিবন্ধনের তথ্য দেয় ১৯টি শ্রেণিতে। এর বাইরে ‘অন্যান্য’ নামের একটি শ্রেণি রয়েছে। দেখা যায়, শুধু অটোরিকশা নিবন্ধন বেড়েছে। বাকি সব শ্রেণিতে নিবন্ধন কমেছে।
বাণিজ্যিক যানবাহনসহ মোটরসাইকেল বিপণনকারী এসিআই মোটরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম, মূল্যস্ফীতি, আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসবের সম্মিলিত প্রভাবে যানবাহন বিক্রি কম হয়েছে।
মোটরসাইকেল ও গাড়ি বিক্রিতে ধস
দেশে বছর বছর মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ছিল। তবে এবার ধস নেমেছে। বিআরটিএর হিসাবে ২০২২ সালে ৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছিল। এবার হয়েছে তিন লাখের মতো।
মোটরসাইকেল বিক্রেতারা জানান, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একেকটি মোটরসাইকেলের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ইতিমধ্যে দু–একটি প্রতিষ্ঠান ১৬৫ সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতা) ওপরের মোটরসাইকেল বাজারে আনতে শুরু করেছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও আনবে। কিছু ক্রেতা বেশি সিসির মোটরসাইকেল কেনার অপেক্ষায় রয়েছেন।
অবশ্য বিক্রেতারা এ–ও বলছেন, সার্বিকভাবে মোটরসাইকেল বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হওয়া।
প্রাইভেট কার নিবন্ধন কমেছে ৩৫ শতাংশ। বিক্রেতারা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও শুল্ক বাড়ায় একেকটি গাড়ির দাম ২ থেকে ৩ লাখ টাকা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিক্রিতে।
রাজধানীর মণিপুরিপাড়ার সংসদ অ্যাভিনিউয়ে গাড়ি কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান রনি কারসের বিক্রয় কর্মকর্তা শুভন খান প্রথম আলোকে বলেন, এখন মানুষের হাতে টাকাপয়সা কম। তাই মানুষ গাড়ি কেনার পেছনে ব্যয় কম করছে।
সাধারণত উচ্চবিত্তরা স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) কেনেন, যা জিপ নামে পরিচিত। ২০২৩ সালে এসইউভি নিবন্ধিত হয়েছে ৭ হাজার ৭৫৬টি, যা আগের বছরের চেয়ে ২ হাজার ৪৭৫টি কম। বিক্রেতারা বলছেন, সরকারি প্রকল্পে গাড়ি কেনা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটিই বিক্রি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। এর পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়া এবং আমদানিতে ডলারের অভাব গাড়ির বাজারে প্রভাব ফেলেছে।
বাস–ট্রাক বিক্রিও কমেছে
বাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি বাণিজ্যিক যানবাহন নিবন্ধনে ভাটার টান লেগেছে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীতে কয়েক বছর ধরে বাসের রুট পারমিট (নির্দিষ্ট পথে চলাচলের অনুমতি) দেওয়া বন্ধ আছে। এ জন্য নতুন বাস কম নামছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা গেল। সারা বিশ্বের মতো দেশেও মন্দা পরিস্থিতি। টায়ার–টিউব থেকে যানবাহনের সব ধরনের যন্ত্রাংশের দাম বাড়তি। তাই এই খাতে মুনাফা কমেছে। বিনিয়োগকারীরাও কম আসছেন। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে বাস বিক্রিতে।
ট্রাক নিবন্ধন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০২২ সালে সাড়ে চার হাজারের মতো ট্রাক নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে নেমেছে ২ হাজার ২৯২টিতে।
ব্যতিক্রম কেবল অটোরিকশা। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর বাড়তি ১ হাজার ৬৫১টি অটোরিকশার নিবন্ধিত হয়েছে। এ সময় মোট ৯ হাজার ২৫৭টি অটোরিকশার নিবন্ধন করানো হয়।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিল্প ও সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমে যাওয়ায় তরুণদের অনেকে অটোরিকশা চালানোকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। চাহিদা থাকায় বেচাকেনাও বাড়তির দিকে।
‘নেতিবাচক প্রভাব আছে’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি যে চাপে রয়েছে, তার একটি চিত্র যানবাহন নিবন্ধনের হিসাবে দেখা যায়। অর্থনীতি ভালো থাকলে, মানুষের আয় পরিস্থিতি ভালো থাকলে, যানবাহন বিক্রি বাড়ে।
গাড়ি নিবন্ধন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া কীসের ইঙ্গিত দেয়—এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে। নতুন গাড়ি যদি সড়কে না নামে, পুরোনো গাড়ি চালাতে থাকলে সেটি সড়ক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ফলে যানজট, দুর্ঘটনা ও পরিবেশদূষণ বেড়ে যাবে।