‘৫ লাখ টাকা গেছে, কিন্তু আমি বেঁচে গেছি’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান গত ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা দেড়টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পূবালী ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তোলেন। এরপর ব্যাংক থেকে বের হয়ে তিনি ইকবাল রোড দিয়ে বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন হঠাৎ করে পেছন থেকে তাঁর সামনে একটি প্রাইভেটকার থামে। গাড়ি থেকে নেমে চারজন কামরুজ্জামানের সামনে আসেন। তখন তাঁদের প্রত্যেকের গায়ে ছিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) জ্যাকেট। নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কামরুজ্জামানকে প্রাইভেটকারে তোলেন। এরপর মারধর করে তাঁর কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেন। পরে কামরুজ্জামানকে ধামরাই রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে প্রাইভেটকারে চলে যান ডিবি পরিচয় দেওয়া চারজন।
কামরুজ্জামান পরে মোহাম্মদপুর থানায় এসে মামলা করেন। মোহাম্মদপুর থানার পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, সংঘবদ্ধ ডাকাত-ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক কামরুজ্জামানকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজন ৫ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক কামরুজ্জামানকে যারা ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা লুট করেছে, তারা ভয়ংকর সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী-ডাকাত দলের সদস্য। তাদের মধ্যে কয়েকজন ২০ বছর ধরে ছিনতাই-ডাকাতি করে আসছে। প্রত্যেকের নামে খুন, ডাকাতিসহ নানা অভিযোগে ঢাকায় মামলা রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এই চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
ব্যাংকের ভেতর ছিল ছিনতাইকারীদের একজন । কামরুজ্জামান সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে অবসরে যান। পরিবার নিয়ে থাকেন আসাদগেট এলাকায়। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একটি ফ্ল্যাটের কিস্তি দেওয়ার জন্য সেদিন তিনি ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তোলেন। কাছে থাকা ব্যাগের ভেতর চার লাখ টাকা রেখেছিলেন। বাকি এক লাখ টাকা রেখেছিলেন প্যান্টের ভেতর। সেদিন দুপুরে ব্যাংকে টাকা তোলার জন্য তিনি লাইনে দাঁড়ান। টাকা তোলার সেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের সদস্য সুলতানুল মাহীদ ওরফে পিয়াস।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাহিদুল ইসলাম বলেন, চক্রের সদস্য পিয়াস সেদিন ব্যাংকের টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একই লাইনে ছিলেন ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান। তিনি যখন পাঁচ লাখ টাকা তোলেন, তখন পেছনে এসে পিয়াস চক্রের অন্য সদস্যদের ফোন দেন। কামরুজ্জামানের পরনে কী আছে, সে তথ্য জানিয়ে দেন। কামরুজ্জামান যখন ব্যাংক থেকে বের হন, তখন বাকি সদস্যরা তাঁকে গাড়িতে তোলেন।
সেদিন কীভাবে কামরুজ্জামান অপহৃত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার পরনে ছিল ডিবির পোশাক। আমাকে তারা বলল, আপনার নামে মামলা আছে? আমি বললাম, কিসের মামলা। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে এবং আমার চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর গাড়ির পেছনের অংশে উপুড় করে ফেলে রাখে। আমাকে মারধর করে। আমার কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।’
যেভাবে ধরা ছিনতাইকারীরা
ভুক্তভোগী কামরুজ্জামানের ঘটনা জানার পর মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ প্রথমে পূবালী ব্যাংকের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজ দেখে। সেখান থেকে একজনের গতিবিধি সন্দেহ হয় পুলিশের। ওই ব্যক্তির ছবি সংগ্রহ করে তাঁর ঠিকানা খোঁজা শুরু করে। এ ছাড়া কামরুজ্জামানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর থেকে ধামরাই পর্যন্ত মোট ২৪০টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। সেখান থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা প্রাইভেটকারের নম্বর জোগাড় করে। সেই সূত্র ধরে প্রথম একজন গাড়িচালককে আটক করে পুলিশ।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সর্বমোট ২৪০টি সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করি। সেখান থেকে প্রথমে ব্যাংকের সন্দেহভাজন ব্যক্তির ঠিকানা বের করি। আর একজন গাড়িচালকের তথ্যের সূত্র ধরে ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রতীক খান ও আহমেদ শিকদার উজ্জ্বলকে গ্রেপ্তার করি। এরপর ধরা হয় সুলতানুল মাহীদ পিয়াসকে।’
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, আসামি প্রতীক খানের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার নতুন কাহেলা গ্রামে। পরিবার নিয়ে তিনি মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরি রোডে বসবাস করেন। চার বছর আগে প্রতীকের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় অস্ত্র মামলা হয়। এর আগের বছর ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বমোট চারটি মামলা আছে। আর আহম্মেদ শিকদার উজ্জ্বলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ দুটি মামলা রয়েছে। অপর আসামি পিয়াসের বিরুদ্ধেও মাদক মামলা আছে।
এসআই সাহিদুল বলেন, গ্রেপ্তার প্রতীক, শিকদার ও পিয়াসের নিজেদের বাড়ি রয়েছে ঢাকায়। প্রতীক ১০ বছর ধরে ছিনতাই-ডাকাতি করে আসছেন। এই চক্রের প্রধান মামুনসহ তিনজন পলাতক। প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত।
আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে পুলিশ বলছে, ভুয়া ডিবি ও র্যাব পরিচয় দিয়ে চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন থেকে ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছেন। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে অবস্থান করেন। পরে ডিবি-র্যাব পরিচয়ে তুলে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেন।
ভুক্তভোগী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কপাল ভালো, আমি এই ভয়ংকর অপরাধীদের হাত থেকে বেঁচে এসেছি।
গাড়িতে তোলার পর আমি হাত-পায়ে ধরে ভুয়া ডিবির সদস্যদের বলেছিলাম, আমাকে তোমরা মেরে ফেলো না। আমার কাছে যে টাকা আছে, তা আমি দিয়ে দিচ্ছি। যে এক ঘণ্টা আমি এই অপরাধীদের হাতে বন্দী ছিলাম, তখন খুব ভয় হচ্ছিল। ওরা আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল। আমার পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।’