৪৫ লাখ টাকা খুইয়ে দুবার স্ট্রোক হয় তাঁর

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আমানতকারীদের কাউন্সিল
ছবি: প্রদীপ সরকার

টাকা বাড়বে সেই আশায় রাজধানীর মিরপুরের জমি ও বাড়ি বিক্রি করা ৪৫ লাখ টাকা ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে রেখেছিলেন সালাহউদ্দিন সিকদার। কয়েক মাস পরই প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের ঘোষণা আসে। বর্তমানে এটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো কোনো টাকা ফেরত পাননি। দুশ্চিন্তায় দুইবার স্ট্রোক করেছেন তিনি।

আজ রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সালাহউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। প্রেসক্লাবে পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনে যোগ দিতে আসেন তিনি। অসুস্থ থাকায় সালাহউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে আসেন তাঁর মা মমতাজ বেগম।

মমতাজ বেগম বলেন, ‘পিপলস লিজিংয়ে টাকা রেখে না পাওয়ায় দুইবার স্ট্রোক করেছে আমার ছেলে। এখন আমরা খুব কষ্টে চলছি। বসুন্ধরায় ছোট একটা ভাড়া বাসায় থাকি। ছেলেটা স্ট্রোক করল, টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারছি না।’

প্রায় ছয় হাজার ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র আমানতকারীর পক্ষে প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আমানতকারীদের কাউন্সিল। সংবাদ সম্মেলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ ও হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন এই বিনিয়োগকারীরা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন আমানতকারী টাকা ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ২০১৯ সালের ১ জুলাই পিপলস লিজিংয়ের অফিসে টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে সেই অফিসেই আনোয়ার হাসান মারা যান বলে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী সামরিন হাসান। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর প্রায় ৫০ লাখ টাকা ছিল পিপলস লিজিংয়ে। কোম্পানি চলমান অবস্থায় তিনি টাকা তুলতে যান পিপলস লিজিংয়ের অফিসে। কী হয়েছে জানি না, সেখানেই আমার স্বামী মারা যান। আমরা সিসিটিভির ফুটেজ চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা দেয়নি।’

সামরিন হাসানের দুই মেয়ে। তাঁদের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সব টাকা পিপলস লিজিংয়ে আটকে থাকায় সামরিন হাসান এখন অসহায়। নিরুপায় সামরিন এখন থাকেন গুলশানে বড় মেয়ের বাসায়।

অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে আজ মানববন্ধনে যোগ দেন মমতাজ বেগম
ছবি: প্রথম আলো

থাইল্যান্ড ও কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রাজিউল হাসান। ২০০০ সালে তিনি অবসরে যান। সারা জীবনের সঞ্চয় ৫০ লাখ টাকা রেখেছিলেন পিপলস লিজিংয়ে। তাঁর ভাইও রেখেছিলেন ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু না পেয়ে এখন সর্বশান্ত তাঁরা। রাজিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা করাতে পারছি না।’

১৯৯৮ সাল থেকে ইতালিতে থাকেন ঢাকার মোহাম্মদবাগের বাসিন্দা কবির খান। করোনার সময় তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০ বছরের বেশি সময়ে বিদেশে থেকে সঞ্চয় করা ৪০ লাখ টাকা তিনি পিপলস লিজিংয়ে রেখেছিলেন। এই টাকা থেকে যে লাভ আসত, তা দিয়ে সংসার চলত। কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই টাকা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। এগুলো যদি চলে যায়, কীভাবে চলব জানি না।’
খালেদ মনসুর ট্রাস্টের ১০ কোটি টাকা রাখা ছিল পিপলস লিজিংয়ে। এই ট্রাস্ট এতিমখানা, ডে নার্সিংসহ প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ও থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করত। কিন্তু পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের পর থেকে তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। ট্রাস্টে কর্মরতরাও বেতন পাচ্ছেন না বলে জানান ট্রাস্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কো–অর্ডিনেটর আজিজা হক।

একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে গেছেন সিদ্দিক উল্লাহ হাওলাদার। তিনি পিপলস লিজিংয়ে আড়াই লাখ টাকা রেখেছিলেন। তবে সেই টাকা তাঁর নিজের ছিল না। ছিল তাঁর আত্মীয় সাবিনা ইয়াসমিনের। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই আড়াই লাখ টাকাই সাবিনা ইয়াসমিনের সম্বল ছিল।

সিদ্দিক উল্লাহ হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবিনা ইয়াসমিন আমার আত্মীয়। তিনি লক্ষ্মীপুরে থাকেন। ঢাকা ভালোভাবে না চেনায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁকে নমিনি রেখে টাকাগুলো পিপলস লিজিংয়ে রাখতে। আমি তা–ই করেছিলাম। সাবিনার স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর এই কিছু টাকাই শেষ সম্বল ছিল।’

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের রুনা একসময় সিদ্দিক উল্লাহ হাওলাদারের বাসায় কাজ করতেন। তাঁর কথা শুনে রুনাও তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় ৩ লাখ টাকা পিপলস লিজিংয়ে রেখেছিলেন। এই টাকা না পেয়ে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে পারছেন না রুনা। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে সবার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। এই দুজনের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ঘুরছেন সিদ্দিক উল্লাহ।

পিপলস লিজিংয়ে ৫০ লাখ টাকা রেখেছিলেন থাইল্যান্ড ও কাতারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান
ছবি: প্রথম আলো

টাকা না পেয়ে পিপলস লিজিংয়ে বিনিয়োগকারী ছয় হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সবাই এ রকম দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। আজকের সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন থেকে তাঁরা দুটি দাবি জানান। একটি হলো, পিপলস লিজিংয়ে আমানতের অর্থ ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা। দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে পিপলস লিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত পি কে হালদার ও দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে আমানতকারীদের অর্থ লুটকারীরা যেন বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, তাঁদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্ধ করা এবং তাঁদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান তাঁরা।

১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পক্ষে সম্মতি দেয় সরকার। আমানতকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি সরকার পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।

বর্তমান সরকার যেমন ফারমার্স ব্যাংক অবসায়ন না করে পদ্মা ব্যাংক নামে ও বিসিআই ব্যাংককে অবসায়ন না করে ইস্টার্ন ব্যাংক নামে পুনর্গঠন করে গ্রাহকদের আমানত ফিরিয়ে দিয়েছে; একইভাবে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানান তাঁরা।