সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন
১১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার জমি বেহাত
অন্তত ৮৭৪ একর জমি বেদখল। উদ্ধারে তৎপর নয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
পরিকল্পিত আবাসন গড়তে মিরপুর ৯ নম্বর সেকশনে ১৬৮ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল সরকার। কিন্তু এখন সরকারের দখলে আছে মাত্র ২৬ দশমিক ১৫ একর। বছরের পর বছর ফেলে রাখায় বাকি জমি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানসহ নানা মহলের হাতে চলে গেছে। এই ৯ নম্বর সেকশনসহ মিরপুরের বিভিন্ন মৌজায় অন্তত ৮৪৭.৮৫ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। এই পুরো জমি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অধীনে। মৌজা দরে এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) ২০২০ সালের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু লোককে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং দায়িত্ব পালনে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।
অধিগ্রহণ করা ৯ নম্বর সেকশনের জমি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নামে গেজেটভুক্ত। কিন্তু ৪০ বছর ধরে তার সিংহভাগ বেদখল হয়ে আছে। টাকার অঙ্কে তা ২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার সম্পত্তি। এই ৯ নম্বর সেকশনসহ পুরো মিরপুরে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নামে ৩ হাজার ৩৫২ দশমিক ৫১ একর জমি আছে। বিপুল এই জমির কতটুকু তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে বা কত একর বেদখল হয়ে আছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাপ্ত জমিতে পর্যায়ক্রমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। পুরো জমির হিসাব করা হয় না। পুরো জমি নিয়ে যদি মাস্টারপ্ল্যান থাকত তাহলে হিসাবও থাকত, জায়গাও সহজে বেহাত হতো না। এই কর্মকর্তা বলেন, বছরের পর বছর জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। কিছু জমি দখল করে দখলদারেরা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে বসে আছে।
মিরপুর-৯ নম্বর সেকশনের বেদখলে থাকা জমির বিষয়ে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা ডিভিশন-১ (মিরপুর)-এর কর্মকর্তারা জানান, একটি সড়ক চওড়া করতে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অনুমতি ছাড়াই ২২ একর জমি নিয়ে গেছে। আর বেসরকারি দুটি আবাসন প্রতিষ্ঠান দখল করেছে ১৯ একর জমি। এই জমি উদ্ধারে মামলা চলছে। এর বাইরে অনুমতি নিয়ে আরও ১১ একর জমি সরকারি দুটি বাহিনী এবং বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। কিছু জমিতে বাংলাদেশে বসবাসরত
আটকে পড়া পাকিস্তানিরা বাসাবাড়ি বানিয়ে থাকছে। এই দখলদারদের মধ্যে আবার বাঙালিরাও আছে।
অধিগ্রহণ করা এসব জমি বাউনিয়া বাঁধ মৌজায় পড়েছে। স্থানীয়দের কাছে এলাকাটি কালাপানি নামে পরিচিত। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ওই জায়গার বড় একটি অংশে বিহারিরা বাসাবাড়ি বানিয়ে থাকছে। বিহারিদের থাকার জন্য আছে একটি স্থায়ী ক্যাম্প। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ক্যাম্প তৈরির আগে তাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি। কিছু জমিতে দুটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দেওয়া।
রাস্তার জন্য জমি নেওয়ার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তা চওড়া করতে গৃহায়ণের জমি নিতে হয়েছে। তবে এর জন্য ওই এলাকায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ আছে। এই টাকা গৃহায়ণকে দেওয়া হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ হাজার ২৬৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১৯৮১ সালে ৯ নম্বর সেকশনের ওই জমি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৮ সালের সরকারি এক আদেশে বেদখল জমি দখলমুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশ্য নিজেদের দখলে থাকা ২৬ দশমিক ১৫ একর জায়গায় স্বপ্ন নগর-১ ও স্বপ্ন নগর-২ নামে দুটি আবাসন তৈরি করেছে গৃহায়ণ। দুটি আবাসনে ২ হাজার ৬০০ ফ্ল্যাট দেওয়ার কার্যক্রম চলছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৯ নম্বর সেকশন ছাড়াও মিরপুর হাউজিং এস্টেটের সাতটি মৌজাতে অন্তত ৬০৯ একর জমির তালিকা করেনি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। এসব জমিও বেদখল হয়ে আছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা। সাতটি মৌজার মধ্যে সেনপাড়া পর্বতা মৌজায় গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে ১২৪ দশমিক ১২ একর জমি অধিগ্রহণের পর গেজেটভুক্ত করা হয়েছিল। একই সময়ে অধিগ্রহণ করার পর গেজেটভুক্ত লালাসরাই মৌজায় ১১৩ দশমিক ৩৬ একর, ধামালকোট মৌজায় ১৩৩ দশমিক ১৭ একর, জোয়ারসাহারা মৌজায় ৭৬ দশমিক ১৬ একর, ইব্রাহিমপুর মৌজায় ১৫১ দশমিক ৪৭ একর, বড় সায়েক মৌজায় ৯ একর এবং ছোট সায়েক মৌজায় ১ দশমিক ৯০ একর জমি কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে অথবা বরাদ্দ, বিক্রি বা কারও কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কি না, এমন কোনো তথ্য গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি।
মিরপুর এলাকায় গৃহায়ণের কী পরিমাণ জমি আছে এবং এর কতটুকু তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে জানতে চাইলে মিরপুর গৃহসংস্থান অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ওমর ফারুক বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব দিতে পারবেন না।
পরে ঢাকা ডিভিশন-১-এর সার্ভেয়ার মতিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পুরো মিরপুর এলাকায় গৃহায়ণের ৩ হাজার ৩৫২ দশমিক ৫১ একর জমির তালিকা আছে বলে জানান। কিন্তু কতটুকু জায়গা তাঁদের দখলে আছে সেই হিসাব তিনিও দিতে পারেননি। মতিন খানের ধারণা, মিরপুর ১২ নম্বরে কুর্মিটোলা বস্তি, মিরপুর ৬ নম্বর এলাকায় চলন্তিকা বস্তি, মিরপুর ১১ বেড়িবাঁধের আশপাশের এলাকায়, সনি সিনেমা হলের বিপরীত পাশে স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেটসহ আশপাশে সরকারের জমি আছে; যা এখন বেদখল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, সব জমি যে বেদখলে আছে, বিষয়টি এমন নয়। কিছু জমি তাঁদের দখলে আছে। এর মধ্যে যেসব জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে বরাদ্দগ্রহীতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যেসব জমি নিয়ে আইনি জটিলতা আছে, তা সুরাহার পর সেখানে তাঁরা উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছেন।
আরও জমি বেদখল
সিএজির বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, মিরপুর ৪ নম্বর সেকশনে ৪৭ বছর আগে অধিগ্রহণ করা ২০ একর জমির ইনভেনটরি (বর্ণনামূলক তালিকা) না করা এবং দখলে না রাখার কারণে সরকারের ৩৬৩ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখলে রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এতে আরও বলা হয়, ওই জায়গায় তিন হাজার ঘর রয়েছে। প্রতি ঘর থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা প্রতি মাসে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। সে হিসাবে মাসেই ২ থেকে ৩ কোটি টাকা চাঁদা উঠছে।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, গৃহায়ণের ওই জায়গায় একটি বস্তি রয়েছে। স্থানীয় লোকজন এটিকে চলন্তিকা বস্তি হিসেবে চেনেন। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সেখান থেকে ভাড়ার নামে চাঁদা তুলছেন। এই কাজে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীও যুক্ত আছেন।
মিরপুর ৪ নম্বর সেকশনের জমিটি সবশেষ সিটি জরিপেও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নামেই রয়েছে। এসব জমি উদ্ধার না করার কারণ হিসেবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু লোককে সরকারি জমি দখল করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের ৩৬৩ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। জানতে চাইলে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা ডিভিশন-১-এর কর্মকর্তারা বলেন, সেখানে কিছু বস্তি গড়ে উঠেছে। উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলে এই জায়গা উদ্ধার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে।
মিরপুর ১ নম্বরে আছে আরও অন্তত ২৩০ কাঠা জমি। সেসবও বেদখল। এর মধ্যে ১ দশমিক ১৫ একর জায়গায় করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেট। মার্কেটের ওই জায়গা অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন প্লট হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বলে জানায় গৃহায়ণ। তবে জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা থাকার কারণে তা দখলে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গৃহায়ণের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মার্কেটটি নির্মাণ করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন ওরফে তিতুর নামও আছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই মার্কেটের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। তবে মার্কেটের কমিটির লোকজনের সঙ্গে মামলা চলছে। তিনি বলেন, গৃহায়ণের জায়গা হলে তারা এটা ভেঙে দিক। তখনই তো দেখা যাবে কারা জমির দাবি নিয়ে সামনে আসে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মিরপুর ১ নম্বরে (সনি সিনেমা হলের বিপরীতে গোলচত্বরসংলগ্ন স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেট এলাকা) ৯৪টি বাণিজ্যিক প্লট, ২১টি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট, ৫৮টি শিল্প প্লট ও ১০১৮টি পুনর্বাসন প্লট রয়েছে। এসব প্লটের কোনো ইনভেনটরি নেই, রেজিস্টার নেই। তবে যাচাই-বাছাই ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে নিরীক্ষা বিভাগ জেনেছে, এসব প্লট ২ থেকে আড়াই কাঠা পরিমাণের। সে হিসাবে ১১৫টি প্লটে জমির পরিমাণ ২৩০ কাঠা, যার বাজারমূল্য অন্তত ১১৫ কোটি টাকা।
বরাদ্দ দিয়েও জায়গা বুঝিয়ে দিচ্ছে না গৃহায়ণ
গৃহায়ণ বলছে, উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু নিজেরা বরাদ্দ দিয়ে সে জমিও বুঝিয়ে দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকে ২৭ বছর আগে ১৪৪ ব্যক্তিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম মেনে তাঁরা টাকাও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জায়গা বুঝিয়ে দেয়নি গৃহায়ণ। মিরপুর ৫ নম্বর সেকশনে সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকায় ৩৬ বছর আগে ৪৪ ব্যক্তিকে প্লটের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ওই জমিও বুঝিয়ে দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। জমি আছে দখলদারদের কাছে।
তবে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলছে। কোন বছর কতটুকু জায়গা উদ্ধার করা হবে, প্রতি বছর তাঁদের এমন টার্গেটও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রক্রিয়া তাঁদের অনুসরণ করতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই চাইব না আমাদের জমি কেউ দখল করুক।’
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দখলদারদের সুবিধা দেওয়ার জন্য যোগসাজশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন। জমি উদ্ধার না করার পেছনে এটাই মূল কারণ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেদখল হয়ে আছে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। জবাবদিহির ব্যবস্থা না করলে এসব বন্ধ করা যাবে না।