বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এক বছর পরই ব্র্যাকের জন্ম। এর লক্ষ্য ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের উন্নয়ন। ৫০ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতির সঙ্গে সব সময় থেকেছে ব্র্যাক। দেশের সীমা ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে এই সংগঠনের কাজ ছড়িয়ে গেছে। ব্র্যাক ভবিষ্যতেও স্বনির্ভরতা ও সামাজির উন্নয়নের লক্ষ্য অবিচল থাকবে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় কথাগুলো বলেন প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা। আজ সোমবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এ মতবিনিময় হয়।
মতবিনিময় সভার শুরুতেই অ্যাসিড–দগ্ধ নারী রত্না মণ্ডলের এগিয়ে যাওয়ার গল্পসংবলিত একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়। নিগ্রহের শিকার হয়েও ঘুরে দাঁড়ানো এক অদম্য নারীর সত্য কাহিনি এটি। এমন অসংখ্য মানুষের দিনবদলের সহযাত্রী ব্র্যাক এ বছর ৫০–এ পা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা শাল্লায় ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর স্বপ্ন এবং দর্শনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বের ১০টি দেশের মানুষের উন্নুয়নে কাজ করছে এই সংস্থা। সাত বছর ধরে বিশ্বের শীর্ষ এনজিওর স্বীকৃতিও অর্জন করেছে সংস্থাটি।
আজকের অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের স্বপ্নদ্রষ্টা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে স্মরণ করেন ব্র্যাকের গভর্নিং বডির চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা আবেদ ভাই এখন সশরীর আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর আদর্শ ও দর্শনই আমাদের চালিকা শক্তি।’
জিল্লুর রহমান বলেন, শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না। স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। এ কাজ করেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। এখন দিন দিন চাহিদার ভিত্তিতে উন্মোচিত হচ্ছে ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়নের নতুন নতুন উদ্ভাবন। ক্ষমতায়নের বিশেষ উপায়।
ব্র্যাককে একটি সফল ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক ক্ষমতায়ন দরকার। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বৈষম্যের ব্যাপক বিস্তার রয়ে গেছে। বৈষম্য আছে জ্ঞানের জগতেও। এর জন্যই জ্ঞানভিত্তিক ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে। ব্র্যাকের আগামীর কর্মকাণ্ড সেই লক্ষ্য বিকশিত হবে।
মতবিনিময়ের সময় ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ার আইরিন খান ব্র্যাককে আইডিয়া ও ঝুঁকির সমন্বয় উল্লেখ করে বলেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে ১০ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে গেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দেবে। তার সঙ্গে রয়েছে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন। তাই দেশ ও দেশের বাইরে আইডিয়া এবং ঝুঁকির সমন্বয় করেই ব্র্যাক এসবের মোকাবিলায় কর্মসূচিগুলো চালাবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এক বছর পরই ব্র্যাকের জন্ম। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেকের চোখে ছিল উন্নয়নের এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু বাংলাদেশ আজ ৫০ বছর পরে বিশ্বের এক বিস্ময় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় না হলে যেমন ব্র্যাকের জন্ম হতো না, তেমনি বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে ব্র্যাক কাজ না করলে এর বিকাশ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়তো আরও অসম হতো। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্ভব হতো না, যদি সরকার আমাদের সহায়তা না করত।
আসিফ সালেহ বলেন, ব্র্যাক বলেছে ত্রাণ নয়, চাই স্বনির্ভরতা ও সামাজিক উন্নয়ন। সমতাপূর্ণ বিশ্বের জন্য স্বনির্ভরতা অর্জন ও সামাজিক উন্নয়নে ব্র্যাক তার লক্ষ্যে অবিচল থাকবে।
ব্র্যাকের ব্যবস্থাপনার পরিচালক (এন্টারপ্রাইজ) তামারা হাসান আবেদ, প্রতিটি মানুষের আছে অমিত সম্ভাবনা। এর বিকাশে চাই সুযোগ সৃষ্টি। ব্র্যাক সব সময় সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট থেকেছে।
তিনটি ক্ষেত্রে ব্র্যাক তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটিয়েছে বলে জানান তামারা আবেদ। প্রথমটি হলো, গ্রামীণ মানুষের উৎপাদিত পণ্য বৃহৎ বাজারে অনুপ্রবেশ। দ্বিতীয়ত, সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং তৃতীয়ত, নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি।
তামারা আবেদ জানান, এখন ২৫ হাজার খামারি ব্র্যাক ডেইরির সঙ্গে আছেন। ১১ লাখ কৃষক আছেন। সেই সঙ্গে আছেন ৬৫ হাজার কারুশিল্পী। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য মুনাফা নয়, দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশের শৈল্পিক সমৃদ্ধির বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে আড়ং।
ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক শামেরান আবেদ তুলে ধরেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ডের চিত্র। তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে আফগানিস্তানে কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের যাত্রা শুরু। গত ২০ বছরে ১৩টি দেশে কাজ করলেও এখন ৯টি দেশে সরাসরি কাজ করছি আমরা। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা যেমন ওই সব কাজে লাগছে, তেমনি বিদেশের অনেক অভিজ্ঞতাও আমরা এই দেশে কাজে লাগাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন ব্র্যাকের পরিচালক (কমিউনিকেশনস, লার্নিং অ্যান্ড লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট) মৌটুসী কবির।