সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ বাঁচাতে প্রতিবাদ, উত্তাপ ফেসবুকেও

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার প্রতিবাদ করছেন নগরবাসী ও বিভিন্ন সংগঠন
ছবি: মানসুরা হোসাইন

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছের ডালপালা দিয়ে একটি বড় পাখির বাসা বানানো হয়েছে। এটি হলো উদ্যান থেকে গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আশিকুল ইসলাম বললেন, ১০ দিনের বেশি সময় ধরে তিনি এবং শিমুল কুম্ভকার ও সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির মিলে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। এখন এ প্রতিবাদের মঞ্চ উন্মুক্ত। এতে অনেকেই সংহতি প্রকাশ করছেন।

আশিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনটি গগনশিরীষগাছ কেটে ফেলেছে। এই গাছগুলোতে চিল বসত। ঢাকার অন্য কোথাও বউ কথা কও পাখির দেখা না মিললেও এই উদ্যানে তার দেখা মিলত। গাছগুলো কেটে ফেললে এই পাখিরা যাবে কোথায়?

উদ্যানের ভেতরেই দেখা হলো নয়ন সরকারের সঙ্গে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ‘সেভ ফিউচার বাংলাদেশ’ নামক একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক। তিনি এবং পরিবেশকর্মী স্বপন মোল্লা নামের একজনও নিজেদের মতো করে গাছ কাটার প্রতিবাদ করছেন। পুরো উদ্যান ঘুরে কোথায় কোথায় গাছ কাটা হয়েছে তার ছবি তুলে রাখছিলেন তাঁরা। তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ করুন। গাছ কাটা বন্ধ করুন। গাছ রক্ষা করুন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও এ গাছ কাটার বিরুদ্ধে উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবাদী বক্তব্য লিখছেন অনেকে। অনেকে গ্রুপ বা দলবদ্ধ হয়েও গাছ রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি দিচ্ছেন। প্রতিবাদের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটাপথ, খাবারের দোকানসহ নানান স্থাপনা তৈরির জন্যই এসব গাছ কাটা হচ্ছে। ফলে আলোচনায় অক্সিজেন বা বাঁচার জন্য গাছ আগে না খাবারের দোকান আগে, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন প্রতিবাদকারীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় এসব উন্নয়নকাজের জন্য কত গাছ কাটা হচ্ছে।

গাছের কাণ্ডে গাছ না কাটার আহ্বান
ছবি: প্রথম আলো

তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, পরিকল্পিত সবুজায়নের অংশ হিসেবে ‘অপ্রয়োজনীয়’ গাছ কাটা হচ্ছে। নতুন ফুল গাছসহ বিভিন্ন গাছ লাগানোও হবে। তবে এতে সন্তুষ্ট নন প্রতিবাদকারীরা। পরিবেশবাদী ছাত্র-যুব সংগঠন ‘গ্রিন ভয়েস’ শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি–সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে গাছ কেটে খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির প্রতিবাদে ছাত্র-যুব সমাবেশের আয়োজন করেছে।
প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনসমাগম হলে মানুষ যাতে উন্নত মানের খাবার পায়, তাই উদ্যানে সাতটি ফুড কিয়স্ক তৈরি করা হচ্ছে। এই একই ছাদের নিচে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীসহ সবার প্রয়োজন অনুযায়ী শৌচাগার, বৃষ্টি হলে শেডের নিচে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা এবং টিকিট কাউন্টার হচ্ছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায়ের নকশা প্রণয়নকারী সংস্থা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থাপত্য অধিদপ্তর। আর প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।

২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং ৫০০টি, দৃষ্টিনন্দন জলাধারসহ হাঁটাপথ, আন্ডারপাস, মসজিদ, অত্যাধুনিক রাইডসহ শিশুপার্কের আধুনিকায়ন, খাবারের দোকান, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য এবং যেখানে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল, সেখানেও একটি ভাস্কর্য তৈরি, ইন্দিরা মঞ্চ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক নির্মাণের কাজ চলছে। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গাছ কাটা হয়েছে। তবে কত গাছ কাটা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো উদ্যানেই ইট, বালু, লোহা পড়ে আছে। খাবারের দোকান বা কিয়স্ক এবং অন্যান্য স্থাপনার পাশাপাশি হাঁটাপথ তৈরির কাজও চলমান। উদ্যানের গাছ কাটার পর কোনো কোনো গাছের গুঁড়ি থেকে নতুন পাতাও গজিয়েছে। উদ্যানের বেশ কিছু গাছে ক্রস চিহ্ন দেওয়া। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, এগুলো দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা, আর আন্দোলনকারীরা বলছেন, এগুলো কাটা হবে বলেই চিহ্ন দেওয়া। ক্রস চিহ্নের হিসাব ধরলে শতাধিক গাছে চিহ্ন দেওয়া।

২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক তৃতীয় পর্যায়ের মহাপরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের উন্নয়নকাজের স্থাপত্য নকশা করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি এবং প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের মাস্টারপ্ল্যানের মূল আকল্পক আসিফুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, উদ্যানের ভেতর যা কিছু হচ্ছে, তা অনুমোদিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই হচ্ছে। আর এ উন্নয়নের ফলে পরিকল্পিতভাবে সবুজের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। তবে বড় গাছ যতটা সম্ভব যাতে না কাটা হয়, সে ধরনের নির্দেশ দেওয়া আছে বলেও তিনি জানালেন।

আন্দোলনকারীদের দুজন
ছবি: প্রথম আলো

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বন্ধ চেয়ে নোটিশ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা বন্ধ করে রেস্তোরাঁ বা দোকান স্থাপনের কার্যক্রম বাতিল চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামিম আখতার এবং প্রধান স্থপতি মীর মনজুর রহমান বরাবর আজ বৃহস্পতিবার ই-মেইলের মাধ্যমে ওই নোটিশ পাঠানো হয়।

৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়ে নোটিশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করে রেস্তোরাঁ বা দোকান স্থাপনের কার্যক্রম বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশের তথ্য অনুসারে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৬ জুলাই হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান সংরক্ষণ করার নির্দেশনা রয়েছে। রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিদ্যমান সব ধরনের স্থাপনা অপসারণ করে চিহ্নিত স্থানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। গাছ কেটে উদ্যানের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থে রেস্তোরাঁ বা দোকান নির্মাণ শুধু আদালতের রায়ই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেরও পরিপন্থী। এসব কারণে গাছ কাটা বন্ধে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ সবুজায়নের কথা বলছে, আবার তারাই গাছ কাটছে উন্নয়নের নামে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

২০০৯ সালে রিটটি করেছিলেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিটের পর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দিয়েছিলেন, সেই রায়ের বাস্তবায়ন হয়নি আজও।

আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফরমস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), নিজেরা করি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শতবর্ষী ও বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের আশ্রয়স্থল গাছগুলো না কাটতে এবং যে গাছগুলো কাটা হয়েছে, সেই জায়গায় একই প্রজাতির ৩ গুণ গাছ লাগানোর দাবি জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে।