সামিয়া বেতন পেয়ে কী কী করবেন, সেই গল্প আর শেষ হয়নি

সামিয়া আফরান

সামিয়া আফরানের নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল আগামী মাসেই। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে এক মাসের বেতনও পাওয়ার কথা। প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে কী কী করবেন, কাকে কী কিনে দেবেন—বন্ধু সুমাইয়া আক্তারের সঙ্গে রিকশায় যেতে যেতে সেই গল্পই করছিলেন সামিয়া। এর মধ্যেই গুলির শব্দ। ব্যস্ত সড়কে মানুষের শোরগোল ও গাড়ির হর্নের মধ্যে কোনো সাড়াশব্দ ছিল না সামিয়ার।

আরও পড়ুন

ঢাকার শাহজাহানপুরে ব্যস্ত সড়কে গত বৃহস্পতিবার রাতে দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন সামিয়া। তখন রিকশায় তাঁর পাশেই বসা ছিলেন বন্ধু সুমাইয়া আক্তার। তিনি সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বয়সী একটা মানুষ। আমার সামনে হারিয়ে গেল। আমি ঘুমাতে পারতেছি না, খেতে পারতেছি না। বাসা থেকে বের হতে ভয় লাগে।’

সামিয়া আফরান জামাল ওরফে প্রীতি (২২) ঢাকার মিরপুরের একটি কারখানার কর্মী জামাল উদ্দিন ও হোসনে আরার দুই সন্তানের একজন। সামিয়া বড়। তাঁর ছোট ভাই সোহাইব জামাল এবারের এসএসসি পরিক্ষার্থী। পরিবার জানায়, সামিয়াও পড়াশোনা করছিলেন। তবে সংসারের অসচ্ছলতা দূর করতে তিনি মাঝখানে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। নতুন করে এপ্রিল মাসের প্রথম দিন আরেকটি চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর।

আমার বয়সী একটা মানুষ। আমার সামনে হারিয়ে গেল। আমি ঘুমাতে পারতেছি না, খেতে পারতেছি না। বাসা থেকে বের হতে ভয় লাগে
সুমাইয়া আক্তার

সুমাইয়া আক্তার গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামিয়া বেতন পেয়ে পরিবারের জন্য কী কী কিনবে, আমাকে কী কিনে দেবে, সেসবই বলছিল। রিকশা চলতে চলতে তখন রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদের সামনে যানজটে এসে থামে, তখন গুলির শব্দ হয়। আগুনের ফুলকি দেখা যায়।’

আরও পড়ুন

সুমাইয়া বলেন, ‘আমি তো কোনো দিন গুলির শব্দ শুনিনি। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম গাড়ির চাকা ফেটে গেছে। আবার মনে হয়েছিল ট্রান্সফরমারের শব্দ। আমি রিকশার যে পাশে ছিলাম, সে পাশেই মাইক্রোবাসটা ছিল। গুলি সে পাশ থেকেই আসছিল।’

গুলির শব্দের পর নিজে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে রাস্তার পাশের একটি দোকানের সামনে চলে যান বলে উল্লেখ করেন সুমাইয়া। তিনি জানান, তিনি ভেবেছিলেন সামিয়া আগেই সরে গেছে। কিছুক্ষণ পর যখন গুলির শব্দ থেমে যায়, তখন তিনি সামিয়াকে ফোন করেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁকে ডাক দিয়ে মানুষের জটলার দিকে নিয়ে যান। গিয়ে সুমাইয়া দেখতে পান সামিয়া অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন।

সুমাইয়া বলেন, ‘ওকে (সামিয়া) ডাকছিলাম। তখনো জানি না ঠিক কী হয়েছিল। এক লোক আর আমি মিলে ওকে সিএনজিতে (অটোরিকশা) উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

সামিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর শরীরে একটি গুলির আঘাত ছিল। পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তরা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে (৫৮) হত্যা করতে গিয়েছিল। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলি সামিয়ার শরীরে লাগে।

সেদিনের কথাগুলো বলতে বলতে সুমাইয়ার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। আবার বলতে শুরু করেন। তিনি জানান, এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে সামিয়ার সঙ্গে দুই বছর আগে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ঘটনার দুদিন আগে হঠাৎ করে একদিন ফোন করে তাঁর বাসায় যান সামিয়া। ঘটনার দিন তাঁর বাসায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বেরিয়ে গিয়েও নিজের বাসায় যাওয়া হয়নি। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে তাঁর মামা আসবেন বলে থাকার জায়গা নেই।

উল্লেখ্য, সামিয়াদের বাসায় তিনটি কক্ষের একটিতে তাঁর মা-বাবা থাকেন। আরেকটিতে সামিয়া তাঁর ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতেন। তৃতীয় কক্ষটি সাবলেট (আরেক জনকে ভাড়া) দিয়ে সংসারে ব্যয়ের চাপ সামলানো হতো।

সুমাইয়া বলেন, ‘আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর প্রীতি (সামিয়া) ফোন দিয়ে আমাকে রেলগেটের (খিলগাঁও) দিকে যেতে বলে। যাওয়ার পর বলে “আজকে রাতটা তোর বাসায় রাখ। কালকে সকালে চলে যাব।”’

রেলগেট থেকে দুই বন্ধু রিকশায় সুমাইয়ার বাসায় ফিরছিলেন। সুমাইয়া বলেন, সামিয়া তাঁকে একটি রিকশা নেওয়ার অনুরোধ করেন। কারণ, তাঁর হাঁটতে ভালো লাগছিল না। রিকশা কিছু দূর এগোনোর পরই ঘটনাটি ঘটে।

সামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন এবং নতুন চাকরিটি নিয়ে তিনি বেশ খুশি ছিলেন জানিয়ে সুমাইয়া বলেন, সামিয়া যেদিন নিহত হন, সেদিন পাঙাশ মাছ দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। নিজে রান্না করে তাঁকে খাওয়ান।

বন্ধু সামিয়া কতটা প্রাণিপ্রেমী ছিলেন, তা–ও জানান সুমাইয়া। বলেন, ‘ও কুকুর, বিড়াল খুব ভালোবাসত। অন্য রকম মেয়ে ছিল। কোনো হিংসা ছিল না।’ সুমাইয়া কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আজকে ওর জায়গায় আমি থাকতে পারতাম। আমি ছিলাম ওই পাশে। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। যে এই কাজ করছে, আল্লাহ যেন তাকে শাস্তি দেয়।’