সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছেন গোলাম সারওয়ার
সাংবাদিকতায় সততা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে গেছেন গোলাম সারওয়ার। সেই আলো পথ দেখাবে আগামীকে। সাংবাদিকতা প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করে পেশাগত উৎকর্ষে সমৃদ্ধ হবে। সৃষ্টিশীল মানুষ মরে না, সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকেন। গোলাম সারওয়ার ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নাগরিক স্মরণসভায় এসব কথা বলেছেন বিশিষ্টজনেরা। স্মরণসভার শুরুতেই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
গোলাম সারওয়ার গত বছরের ১৩ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ের প্রধান মিলনায়তনে স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ভাষাসৈনিক ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন।
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, গোলাম সারওয়ারের মতো ছাত্র পেয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে গর্বিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক ষাটের দশকের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ১৯৬৩ সালে বাংলা বিভাগ বাংলা ভাষা, সাহিত্যের হাজার বছরের উৎসব পালন করে। সে সময়ে যে কয়েকজন ছাত্র এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের অন্যতম গোলাম সারওয়ার।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গোলাম সারওয়ারের প্রতি সম্মান জানানোর একটিই উপায় হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রসার, সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করা এবং দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্য কথা বলায় দৃঢ়তা নিয়ে আসা। তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ারের অনুপ্রেরণাতেই সম্পাদক পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, গোলাম সারওয়ার যত বড় মানের সাংবাদিক ছিলেন, তার চেয়েও বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তিনি আজীবন লড়াকু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। রাজনীতিকদের প্রশংসা করতেন, আবার কড়া সমালোচকও ছিলেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, গোলাম সারওয়ার উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন। তাঁর দেখানো পথে দেশের সাংবাদিকতা ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্রান্তিকাল পেরিয়ে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। তাঁদের অনেক স্মৃতি। এখন সাংবাদিকতা স্থবির হয়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। গোলাম সারওয়ারকে অনুসরণ করে তা যদি সার্বিকভাবে ক্যামেরা ও ভাষায় প্রয়োগ করতে পারা যায়, তাহলেই কেবল এই ক্ষয়রোধ সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, ‘কৌশল এমন এক শিল্প, আপনি কাজ করবেন কিন্তু শত্রু তৈরি হবে না—এই আদর্শের সার্থক মানুষ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি কাজ করেছেন সারা জীবন, কিন্তু কারও বিরাগভাজন হননি। তিনি শুধু সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।’
সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, আপাদমস্তক পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন গোলাম সারওয়ার। সবচেয়ে কঠিন পেশা সাংবাদিকতা করেছেন সাহসের সঙ্গে। কোনো সংবাদ কারও পক্ষে গেলে তারা তা প্রাপ্য মনে করে। কিন্তু বিপক্ষে গেলে যেভাবে পারে সংবাদপত্রের মালিককে দেখে নেয়। গোলাম সারওয়ার সংবাদে আপস করতেন না। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে এর অভাব রয়েছে। আপস করতে করতে সাংবাদিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, মানুষ আর পত্রিকা পড়তে চায় না।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গোলাম সারওয়ার সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার প্রচেষ্টায় তার এলাকায় স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার দেখানো পথ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে পেশাগত দায়িত্বপালনে উদ্বুদ্ধ করবে।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি স্বাগত বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর চলে যাওয়া আরও পরে হলে তাঁর ছোঁয়ায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আলোকিত যাত্রাপথটি আরও দীর্ঘ হতো। তিনি নেই, কিন্তু এখনো তাঁর সহযাত্রী হয়ে, তাঁর দেখানো পথেই চলছে সমকাল। সে পথেই চলবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনকে তৈরি করা মানুষ গোলাম সারওয়ার। গণমাধ্যমে যে ক্ষয়িঞ্চুতা সৃষ্টি হয়েছে, তা রোধে গোলাম সারওয়ারের আদর্শের বিকল্প নেই। গণমাধ্যমকে গণমানুষের মুখপাত্রে পরিণত করতে গোলাম সারওয়ারের আদর্শকে ধারণ করতে হবে।
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, পিকেএসএফ চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, নাট্যজন আতাউর রহমান, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কবি কামাল চৌধুরী, তথ্যসচিব আবদুল মালেক, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ইকবাল আরসালান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, বিএফইউজে মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী ও ডিআরইউ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন।
এ অনুষ্ঠানে গোলাম সারওয়ারের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাঁর সহোদর গোলাম হায়দার, জামাতা মিয়া নাইম হাবিব এবং ভাগনে শামীম হাসান।