২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি: শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা পরিকল্পিত

শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে সমাবেশে অংশ নেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা
ছবি: প্রথম আলো

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনাসহ সারা দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনার বিভিন্ন ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে দাবি করেছেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা বলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ মহিরুহের আকার ধারণ করছে। প্রশাসনে-পুলিশে-শিক্ষায়-নিরাপত্তা বাহিনীতে কারা চাকরি পাচ্ছেন, সরকারকে এটি দেখতে হবে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে পরীক্ষা দিতে দাঁড়িয়েছেন কি না, তা দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে এসব জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।

মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক সমাবেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন। নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে নির্যাতনের প্রতিবাদে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এই সমাবেশের আয়োজন করে।

সমাবেশে অংশ নিয়ে প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমরা যখন পদ্মা সেতুর আলোকচ্ছটার দিকে তাকিয়ে আছি, তখন আমরা খেয়াল করছি না যে কী ভয়াবহ অন্ধকার আমাদের সমাজকে গ্রাস করেছে। নড়াইলে কলেজের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছনার ঘটনায় তাঁকে যাঁরা অপসারণ করতে চান, তাঁদের একটা ইন্ধন ছিল বলে আমরা জেনেছি। পুলিশ সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে শিক্ষকদের এত সংগঠন থাকা সত্ত্বেও, একটি সংগঠনও নড়াইলের শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করল না। কেন? তারা কী অপেক্ষা করছে, কবে তাদের নিজেদের গলায় জুতার মালা আসবে? ওই জুতার মালা শুধু শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় নয়, সবার গলাতেই ওই মালা ঝুলছে। আশা করব সবাই যাতে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানান। রুখে দাঁড়ালেই এসব অন্যায়ের প্রতিবিধান সম্ভব হবে। নাহলে সমাজকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা একেবারেই কঠিন কাজ হবে।’

সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ এখন মহিরুহের আকার ধারণ করছে বলে মন্তব্য করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নির্মাণের সাফল্যে ২৫ জুন যখন আমরা সবাই ঐক্যের সুরে একত্র হয়েছিলাম, সেদিনও আমরা জানতাম না যে কী ভয়ংকর দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। পরের দিন সকালে খবর পেলাম, নড়াইলের একটি কলেজের অধ্যক্ষকে পুলিশের সামনে গলায় জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা হয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব ছিল মালাটি খুলে ফেলা, কিন্তু তা তারা করেনি। মাথা নত করে একজন শিক্ষক পুলিশের গাড়িতে উঠলেন। আমাদের মনে হয়, এ ধরনের ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। গত কয়েক বছরে যে কয়েকজন শিক্ষক নিগৃহীত হয়েছেন, প্রত্যেকেই সনাতন ধর্মের মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বলতে ইচ্ছা করে, এ কোন বাংলাদেশ আমরা প্রত্যক্ষ করছি! এই বাংলাদেশ কি আমরা কখনো চেয়েছিলাম?’

শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দেশের শিক্ষকসংগঠনগুলোর নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ৷ তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ধসে গেছে। এর কারণ, শুধু শিক্ষাব্যবস্থায়ই নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত রাজনীতি, পাঠ্যসূচি, মাদ্রাসাসহ বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক-অভিভাবক-ম্যানেজিং কমিটি-মন্ত্রণালয়, সবকিছুই। এসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে যেসব শিক্ষক শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে চান, তাঁদের দশা নড়াইলের সেই অধ্যক্ষ, সাভারের সেই শিক্ষক ও হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের মতো হয়। আমরা পঞ্চাশ-ষাট দশকের ছাত্র। শিক্ষক লাঞ্ছনার কোনো উদাহরণ আমরা কোথাও দেখিনি। কিন্তু ভালো শিক্ষকেরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন, যদিও খারাপ শিক্ষকেরা খুব আনন্দে আছেন। আমলাতন্ত্র আমাদের দেশ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে শেষ করে দিচ্ছে। কোথাও কোনো আশা নেই। একমাত্র গণজাগরণ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের জাগরণ ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবিলার আর কোনো উপায় নেই।’

সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি ঝুনা চৌধুরী, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামান, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজীনা ওয়ালী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গিয়াস প্রমুখ।

প্রসঙ্গত, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাময়িক বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের এক ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ১৮ জুন কলেজের অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ওই ছাত্র ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাঁকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন। তখন অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের ‘পক্ষ নিয়েছেন’, এমন রটনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হয়।

এ সময় উত্তেজিত ছাত্ররা অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁদেরও সংঘর্ষ হয়। এ সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের কিছু ছাত্র ও স্থানীয় ব্যক্তি পুলিশের উপস্থিতিতে স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন।