লাফিয়ে বাড়ে বাড়িভাড়া, অভিযোগ শোনার কেউ নেই
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দুই বছর আগে ১৪ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আমিনুর রহমান। গত জানুয়ারিতে বাড়ির মালিক এক লাফে দুই হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। বাড়তি ভাড়া দিতে রাজি না হওয়ায় ওই মাসেই বাড়ির মালিক তাঁকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেন। যদিও চুক্তি অনুযায়ী অন্তত দুই মাস আগে নোটিশ দিতে হবে। আমিনুর রহমান বলেন, ‘এমন অবস্থায় বাসা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। বাড়ির মালিকের সঙ্গে লড়াই করে বাসায় থাকা সম্ভব না।’
শুধু ভাড়া বৃদ্ধি নয়, নির্দিষ্ট সময়ের পর বাড়ির গেট খোলা না পাওয়া, বিদ্যুতের আলাদা মিটার ছাড়াই অতিরিক্ত বিল দেওয়া, ইচ্ছেমতো গ্যারেজ ও সার্ভিস চার্জ, পানির জন্য অতিরিক্ত টাকা, দিনে নির্দিষ্ট একটি সময়ে পানি পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে ঢাকা শহরের অনেক ভাড়াটের।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে প্রায় ৪০০ শতাংশ বাড়িভাড়া বেড়েছে। আর এই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
অথচ বাড়িভাড়াকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে কোনো সংস্থারই কোনো উদ্যোগ নেই। ভাড়াটে অভিযোগ জানাবেন এমন কোনো সংস্থাও নেই। বাস্তবায়ন নেই ২৮ বছর আগে পাস হওয়া বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনেরও। আইনটি কার্যকরের অংশ হিসেবে চার বছর আগে উচ্চ আদালত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা–ও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৮ সালে এলাকা ও বাড়ির প্রকৃতিভেদে প্রতি বর্গফুটের জন্য ৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। সেটিও কার্যকর হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আইনের খসড়ায় সেবা খাতে বাড়িভাড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভা বিভাগের আইন যাচাই-বাছাইসংক্রান্ত কমিটিতে আছে।
আইনটি পাস হলে ভাড়াটেরা কী সুবিধা পাবেন—জানতে চাইলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বাড়ির মালিক হঠাৎ নোটিশ দিয়ে বাসা ছাড়তে বললে, অতিরিক্ত ভাড়া বা অন্য কোনো চার্জ নিলে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে ভাড়াটেরা অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাড়ির মালিককে এক বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
>গত ২৫ বছরে রাজধানীতে প্রায় ৪০০ শতাংশ বাড়িভাড়া বেড়েছে
আর এই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ
নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ
বাড়িভাড়াকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে কোনো উদ্যোগ নেই
আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
ভোক্তা অধিকারের বিদ্যমান আইনে (২০০৯ সালের আইন) সেবা বলতে টেলিযোগাযোগ, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নির্মাণ, আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ এবং স্বাস্থ্য খাত অন্তর্ভুক্ত। সংশোধিত আইনে এসবের সঙ্গে বাড়িভাড়া, ইন্টারনেট, অনলাইন সার্ভিস, কেব্ল অপারেটরসহ বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাসুম আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ে অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে বাড়িভাড়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় কোনো প্রতিকার দেওয়া যায় না। ভাড়াটেদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে খসড়ায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খসড়াটির অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।’
অধিদপ্তরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ঢাকা জজকোর্টের একজন সহকারী জজকে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাড়িভাড়া নিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে তাঁর কাছে প্রতিকারের জন্য আবেদন করা যায়। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই সেখানে যান না। এমন অবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বাড়িভাড়ার বিষয়টি যুক্ত হলে হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকবে। ক্যাব বলছে, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকায়। গত বছর এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়।
যদিও সিটি করপোরেশনের ভাড়ার হার অনুযায়ী, মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিং এলাকায় পাকা বাড়ির প্রতি বর্গফুটের জন্য নির্ধারিত ভাড়া ৬ টাকা। এই হিসাবে ১০০০ বর্গফুটের বাসা ভাড়া হবে মাত্র ছয় হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই টাকায় ওই এলাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু বাড়ির মালিকেরা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী গৃহকর দেন। এ ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকেরা সুবিধা পেলেও বঞ্চিত হন ভাড়াটেরা।
জানতে চাইলে এক বাড়ির মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার হার হাস্যকর। জমির দাম, বাড়ির নির্মাণ খরচ—সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক ভাড়ার হার নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে ভাড়াটে, বাড়ির মালিক ও সিটি করপোরেশন—সব পক্ষই লাভবান হবে।
গত সপ্তাহে কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিরাজ হাসানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, প্রতিবছর ৫০০-১০০০ টাকা বাসাভাড়া বাড়ানো হয়। এ ছাড়া সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। সরকারি কোনো সংস্থার হস্তক্ষেপ না থাকায় বাড়িভাড়া এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।